নয়াদিল্লি: সদ্য গুজরাটে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে ফের ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। আর তারপরেই তারা সক্রিয় হয়েছে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিল পাশ করে সেটিকে আইনে পরিণত করতে। আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে এটাই বিজেপির নয়া হাতিয়ার হতে চলেছে। জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ, তাৎক্ষণিক তিনতালাক আইন প্রণয়ন ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে বারবার তোলপাড় হয়েছে কেন্দ্রীয় রাজনীতি। এবার বিজেপি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকরের জন্য ঝাঁপানোর প্রস্তুতি নিয়েছে। আর সেই সূত্রে শুক্রবার রাজ্যসভায় পাশ হয়ে গেল অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিল। যা নিয়ে উত্তপ্ত হল সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভা। কি হয়েছে এদিন?
আসলে এদিন বিরোধীদের আপত্তি ধোপে টেকেনি। বিরোধীদের যাবতীয় বাধা টপকে রাজ্যসভায় পাশ হয়ে যায় অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিল। অধিবেশন কক্ষে বিরোধীরা এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে অধিবেশন কক্ষ। এদিন অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিলটি উত্থাপন করেন রাজস্থানের বিজেপি সাংসদ কিরোডিলাল মিনা। বিলটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন বিজেপি বিরোধী সাংসদরা। তখন অধিবেশন কক্ষে তুমুল হই-হট্টগোল শুরু হয়। বিরোধীরা বিলটিকে আটকে দেওয়ার জন্য আবেদন জানান রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনকড়ের কাছে। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। তুমুল হাঙ্গামার মধ্যেই বিলটি পাশ হয়ে যায়।
বিজেপি সাংসদ কিরোডিলাল মিনা প্রাইভেট মেম্বার বিল হিসেবে ভারতে ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ২০২০’ বিলটি এদিন পেশ করেন। তার পরিপ্রেক্ষিতেই বিলটির বিরোধিতা করে তিনটি মোশন জমা দেন বিরোধীরা। কিন্তু ধ্বনিভোটে ৬৩-২৩ ভোটে সেটি খারিজ হয়ে যায়। এদিন কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম, সিপিআই, ডিএমকে’র সাংসদরা বিলটির তীব্র বিরোধিতা করেন। এই বিল ভারতের গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক কাঠামোকে ধ্বংস করবে বলে অভিযোগ করেন তাঁরা। এই বিল ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী বলেও তাঁরা দাবি করেন। এরপর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল এ বিষয়ে বিরোধীদের নিশানা করেন। তিনি বলেন, ‘‘অধিবেশনে এটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু তার আগে সরকারের সমালোচনা এবং বিলের বিরোধিতার কোনও মানে হয় না।’’
পীযুষের এই বক্তব্যের পরেই চেয়ারম্যান জগদীপ ধনকড় ধ্বনিভোটের নির্দেশ দেন। সেখানে অনায়াসে বিলটি পাশ হয়ে যায়। সিপিএমের রাজ্যসভার সাংসদ জন ব্রিট্টাস বিলটির বিরোধিতা করতে গিয়ে আইন কমিশনের একটি রিপোর্টকে হাতিয়ার করেন। তাঁর দাবি আইন কমিশনে বলা হয়েছে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি অপ্রয়োজনীয় এবং সেটি কাম্য নয়। ডিএমকে’র সাংসদ তিরুচি সিভা দাবি করেন, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী। তার পাল্টা বিজেপি সাংসদ হরনাথ সিংহ যাদব অভিন্ন দেওয়ানি বিধি দেশ জুড়ে চালু করা নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে ‘জ়িরো আওয়ার’-এ নোটিস দেন। সবমিলিয়ে বিলটি নিয়ে দিনভর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজ্যসভা।
সদ্য গুজরাটে বিপুল সংখ্যক আসনে জিতে রীতিমতো রেকর্ড সৃষ্টি করে ফের ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। গুজরাট নির্বাচনে বিজেপির ইস্তাহারে সেই রাজ্যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া বিজেপি শাসিত অসম, উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশেও এই আইন কার্যকর করার কথা বারবার বলা হয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনেও বিজেপির ইস্তাহারে বিষয়টির উল্লেখ করা হয়েছিল। এই আবহের মধ্যে শুক্রবার রাজ্যসভায় পাশ হয়ে গেল অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিলটি।
বিবাহ বা বিবাহ বিচ্ছেদ, দত্তক নেওয়া বা উত্তরাধিকার বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে দেশে বিভিন্ন ধর্ম ও জনজাতির মধ্যে পৃথক পৃথক আইন রয়েছে। সেক্ষেত্রে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আইন প্রণয়ন হলে সমস্ত নাগরিককে একই ধরনের পারিবারিক আইন মেনে চলতে হবে। আর এই বিধি চালু করতে উঠে পড়ে লেগেছে গেরুয়া শিবির। গুজরাট নির্বাচন মিটে যেতেই বিষয়টি নিয়ে আসরে নেমে পড়েছে বিজেপি।
রাজনৈতিক মহল মনে করে অভিন্ন দেওয়ানি আইন নিয়ে যত বিতর্ক হবে ততই ধর্মীয় মেরুকরণের সুবিধা পেতে চাইবে বিজেপি। তবে এই আইনের বিরুদ্ধে জনজাতিরাও বিক্ষোভ দেখাতে পারেন। সেক্ষেত্রে সেগুলি কীভাবে গেরুয়া শিবির মেটাতে পারবে সেটাও দেখার অপেক্ষায় রয়েছে রাজনৈতিক মহল। বিরোধীদের দাবি এই বিতর্ক উসকে দিয়ে লোকসভা নির্বাচনের আগে নতুন করে বিজেপি অশান্তির বাতাবরণ তৈরি করতে চাইছে। কারণ অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকর হলে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে যে প্রচলিত আইন চালু হয়েছে, সেগুলি রাতারাতি গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। আর সেই বিষয়টি নিয়ে দেখা দেবে সমস্যা। যদিও বিজেপির বক্তব্য হল একই দেশে পৃথক পৃথক আইন কেন থাকবে? সব মিলিয়ে লোকসভা নির্বাচনের আগে দেড় বছর ধরে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আইন নিয়ে যে বিতর্ক চলতেই থাকবে সেটা স্পষ্ট।