নিজস্ব প্রতিনিধি: বাম জমানায় ভোটারদের সচিত্র পরিচয়পত্রের দাবিতে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান ঘিরে তুলকালাম পরিস্থিতি তৈরি হয়। ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই সেই অভিযান হয়, যেখানে পুলিশের গুলিতে ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মীর মৃত্যু হয়েছিল। তখন মমতা নিয়মিত অভিযোগ করে বলতেন ভোটার তালিকায় লক্ষ লক্ষ ভুয়ো নাম রয়েছে। তালিকা থেকে সেই নামগুলি সরানোর দাবিতে তাঁর সক্রিয়তা বরাবরই সবার নজর কেড়েছে। তারপর কেটে গিয়েছে তিন দশক। এখন আর বিরোধী নয়, গত ১১ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন আগামী বছরের জন্য যে ভোটার তালিকার খসড়া সামনে এনেছে তাতে দেখা যাচ্ছে অনেক নাম বাদ পড়েছে। ভোটার সংখ্যা বাড়ার বদলে সেটি কমে গিয়েছে। যা দেখে প্রবল ক্ষুব্ধ হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বিষয়টি নিয়ে সরাসরি বিজেপিকে নিশানা করেছেন। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহলের প্রশ্ন, তবে কি সত্যিই তালিকায় হাজার হাজার ভুয়ো ভোটারের নাম ছিল, আর সেই কারণেই সেগুলি এবার বাদ পড়েছে?
আগামী বছরের জন্য পশ্চিমবঙ্গের খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন। সেখানে ভোটারের সংখ্যা আগের চেয়ে কমেছে। গত বছর ভোটার সংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৪৩ লক্ষ ৮১০। যা খসড়া ভোটার তালিকায় এবার কমে হয়েছে সাত কোটি ৪২ লক্ষ ৮৮ হাজার ২৩৩ জন। সাধারণ ভাবে প্রতি বছর ভোটারের সংখ্যা বাড়ে। কিন্তু খসড়া তালিকায় দেখা যাচ্ছে সেটি এক বছরে ১২ হাজার ৫৭৭ টি কমে গিয়েছে। যে বিষয়টি নিয়ে কৃষ্ণনগরে একটি কর্মসূচিতে উপস্থিত থেকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন,”বিজেপি অনেক জায়গায় ৩০ শতাংশ ভোটারের নাম ভোটার লিস্ট থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। আপনাদের নিজেদের দেখতে হবে আপনার নাম ভোটার তালিকায় আছে কিনা। ভোটার তালিকায় নাম না থাকলে কোনও রকম সুযোগ সুবিধা পাওয়া যাবে না। রেশন কার্ড থেকে নাম কেটে দেবে। ভোটার তালিকা থেকেও নাম কেটে দেবে।”
প্রতি বছরই ভোটার তালিকায় সংশোধনের কাজ করে নির্বাচন কমিশন। আর অতীতে দেখা গিয়েছে প্রতি বছর রাজ্যগুলিতে ভোটারের সংখ্যা বাড়ে। কিন্তু এবার নজিরবিহীনভাবে পশ্চিমবঙ্গে ভোটারের সংখ্যা কমেছে। নির্বাচন কমিশন যে পরিসংখ্যান পেশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে রাজ্যে নতুন ভোটার হিসেবে নাম নথিভুক্ত করেছেন ২ লক্ষ ৬৬ হাজার ৮৫৭ জন। সেখানে তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন ২ লক্ষ ৭৯ হাজার ৪৩৪ জন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই মৃত। এছাড়া কমিশন জানিয়েছে ওই তালিকায় বেশ কিছু অস্তিত্বহীন ভোটারের নাম ছিল। তাঁদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই কমেছে ভোটারের সংখ্যা। কিছুদিন আগেই রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক আরিজ আফতাব একটি সর্বদল বৈঠক ডেকেছিলেন। সেখানে রাজ্যের বিরোধী দলগুলি অভিযোগ করে বলে ভোটার তালিকায় নাকি প্রচুর ‘ভুতুড়ে’ নাম রয়েছে। সেই সমস্ত নাম বাদ দেওয়ার দাবি তোলেন বিরোধী নেতারা। তবে কি বিরোধীদের দাবি মেনেই তালিকা থেকে ভোটারের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে? এই প্রশ্ন করছে শাসক দল তৃণমূল।
যদিও নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, খসড়া ভোটার তালিকা নিয়ে কোনও অভিযোগ থাকলে সেটি ৪ ডিসেম্বরের মধ্যে কমিশনকে জানাতে হবে। প্রতি শনি ও রবিবার রাজ্যে মোট আটটি বিশেষ শিবিরের আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন। সেই শিবিরে অভিযোগ জানানো যাবে। এর পাশাপাশি কমিশনে যাঁরা যেতে পারবেন না তাঁরা ১৯৫০ টোল ফ্রি নম্বরে ফোন করেও অভিযোগ জানাতে পারবেন বলেও কমিশন জানিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি রাজ্য রাজনীতিতে চর্চার অন্যতম বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে ভোটার তালিকা থেকে যেভাবে বিপুল সংখ্যক ভোটারের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে খসড়া তালিকায়, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। বিরোধীদের দাবি মূলত ভুয়ো ভোটারদের নাম তালিকা থেকে বাদ গিয়েছে। শুধু তাই নয়, এখনও প্রচুর ভুয়ো ভোটারের নাম তালিকায় রয়েছে বলেও বিরোধীরা মনে করছেন। বাম জমানায় রাজনীতির কারবারিরা বলতেন সিপিএম তাদের ভোট মেশিনারি শুরু করে ভোটার তালিকা থেকে। তাই শুরুতেই পিছিয়ে পড়ত বিরোধীরা। তবে কি সেই জায়গা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার বিরোধীরা ভোটার তালিকা নিয়ে নতুন করে কোমর বেঁধে নামতে চাইছে? এই প্রশ্ন অবধারিত ভাবে উঠছে। তাই আগামী বছরে নির্বাচন কমিশন নতুন করে যে পূর্ণাঙ্গ ভোটার তালিকা প্রকাশ করবে তাতে আরও পরিবর্তন দেখা যায় কিনা এখন তারই অপেক্ষা।