নিজস্ব প্রতিনিধি: ক্ষমতার ভরকেন্দ্র! আর এই শব্দবন্ধকে ঘিরেই যত সমস্যা। যা ফের প্রকট হয়ে উঠল তৃণমূলে। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ও কোচবিহার পুরসভার চেয়ারম্যান রবীন্দ্রনাথ ঘোষ ফেসবুক পোস্টে যে মন্তব্য করেছেন তাতে তৃণমূলের অস্বস্তি রাতারাতি বহু গুণে বেড়ে গিয়েছে। তিনি ফেসবুক পোস্টে মন্তব্য করেছেন, পুরনো তৃণমূল কর্মীরা ভাল নেই। আর তাতেই তৃণমূলে আদি ও নব্যের দ্বন্দ্ব নতুন করে মাথাচাড়া দিল। রাজনৈতিক মহল মনে করছে যেভাবে কোচবিহারে ক্ষমতা হারিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, তাতেই এমন মন্তব্য করেছেন তিনি।
তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গী। টানা ২২ বছর তৃণমূলের কোচবিহার জেলা সভাপতি ছিলেন তিনি। কিন্তু ২০১৯ সালে কোচবিহার লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির কাছে তৃণমূল হেরে যাওয়ার পর থেকেই দলে তাঁর গুরুত্ব কমতে থাকে। লোকসভা আসনে হেরে যাওয়ার পর জেলা রাজনীতিতে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী নবীন প্রজন্মের নেতা পার্থপ্রতিম রায় এখন অনেক বেশি সক্রিয়। এমনকী ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে তৃণমূলে যোগদান করার পর উদয়ন গুহের রমরমা ও দাপট কোচবিহার জুড়ে ক্রমশ বেড়েছে। আর একুশের বিধানসভা নির্বাচনে রবীন্দ্রনাথ ঘোষ হেরে যাওয়ার পর জেলা রাজনীতিতে তাঁর গুরুত্ব আরও কমে যায়। বর্তমানে তিনি কোচবিহার পুরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন। কিন্তু জেলায় এতদিন তাঁর যে ‘কমান্ড’ ছিল সেটা বহুদিন চলে গিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন দলে আদিরা ভাল অবস্থায় নেই। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে তাঁর এই মন্তব্য নিঃসন্দেহে তৃণমূলকে অস্বস্তিতে ফেলল। যদিও জেলা তৃণমূল এই বিষয়টি নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি। আর বিতর্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন তৃণমূল নেতা পার্থপ্রতিম রায়। তিনি ফেসবুক পোস্ট করে লিখেছেন, ‘বিলম্বিত বোধোদয়’! সেই সঙ্গে লিখেছেন ‘ক্রিকেট বিশ্বকাপ, ফুটবল বিশ্বকাপ’! স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রনাথ ঘোষের পোস্টের পাল্টা পার্থপ্রতিম যে পোস্ট করেছেন তাতে বিতর্ক আরও বেড়েছে। উল্লেখ্য রবীন্দ্রনাথ ঘোষের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত জিতেন বর্মন, বিনয়কৃষ্ণ বর্মনরাও এখন দলে যথেষ্ট কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছেন। তাই সব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঘোষ একেবারেই স্বস্তিতে নেই। জেলায় তিনি ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছেন বলে কোচবিহারে কান পাতলেই শোনা যায়। যে বিষয়টিকে একেবারেই ভাল চোখে দেখছেন না পুরনো দিনের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। এর প্রভাব পঞ্চায়েত নির্বাচনে অবশ্যই পড়বে বলে জেলা নেতৃত্বের একাংশ মনে করছেন।
গত কয়েক বছর ধরে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুরুত্ব বহু গুণে বেড়ে যাওয়ার পর থেকেই এই ধরনের সমস্যা শুরু হয়েছে বলে রাজনৈতিক মহল মনে করে। বহু জায়গায় আদি তৃণমূল নেতাদের গুরুত্ব কমছে বলে অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। কয়েক মাস আগে হাওড়া জেলার উদয়নারায়ণপুরের তৃণমূল বিধায়ক সমীর পাঁজা ফেসবুক পোস্টে যে মন্তব্য করেছিলেন তাতে বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। তাতে তিনি লিখেছিলেন,” মহান নেত্রী আছেন বলেই আমি আজও তৃণমূল দল ছেড়ে যাইনি।
কারণ কত ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে, নানান ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ৩৮টা বছর এই মহান নেত্রীর সঙ্গে একজন সৈনিক হিসেবে কাজ করতে করতে এখন বড়ই বেমানান লাগছে নিজেকে। আমার মতো অবিভক্ত যুব কংগ্রেসের আমল থেকে যারা আছে, তারা আদৌ কোনও গুরুত্ব পাচ্ছে কি বর্তমানে? তাই আর কি, আমার যাওয়ার সময় হল, দাও বিদায়!” সেই সঙ্গে পোস্টে তিনি আরও লিখেছেন,”আজ অবধি মিথ্যা নাটক করে দলীয় নেতৃত্বের কাছে ভাল সেজে একটা মেকি লিডার হতে চাই না আমি। না হলে কবে টাটা বাই বাই করে দল ছেড়ে চলে যেতাম আমি”। যদিও তার একদিন পরেই তিনি নিজের বক্তব্য থেকে সরে আসেন। কিন্তু এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কতটা ক্ষোভ রয়েছে তাঁর মধ্যে। একটা দুটো জেলা বলে নয়, রাজ্য জুড়ে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করে। তাই পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে নবীন-প্রবীণের দ্বন্দ্ব মেটাতে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব কি পদক্ষেপ করেন এখন সেটাই দেখার।