নিজস্ব প্রতিনিধি: বেজে গিয়েছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দামামা৷ সর্বসম্মতভাবে যশবন্ত সিনহার নামে সিলমোহর দিয়েছে বিরোধীরা। অন্যদিকে, যাবতীয় জল্পনার অবসান ঘটিয়ে বিজেপি রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছে জনজাতি সমাজের অন্যতম প্রধান মুখ দ্রৌপদী মুর্মুকে। মঙ্গলবার দুপুরে দিল্লিতে এনসিপি প্রধান শরদ পওয়ারের বাড়িতে ১৮টি দলের বৈঠকে বিরোধীদের তরফে রাষ্ট্রপতি পদে প্রাক্তন বিজেপি তথা সদ্য প্রাক্তন তৃণমূল নেতা যশবন্ত সিনহার নামেই সিলমোহর দেওয়া হয়৷ ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার সাঁওতাল পরিবারের কন্যা দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করেছে এনডিএ শিবির৷ তিনি এর আগে ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল হিসেবে কাজ করেছেন। তার আগে ওড়িশায় মন্ত্রীও হয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে শাসক-বিরোধীদের ভোটের হার যা, তাতে নির্বাচনে যশবন্তর থেকে বেশ কিছুটা এগিয়ে দ্রৌপদী৷ এবার দেখে নেওয়া যাক, দেশের হবু রাষ্ট্রপতির পরিচয়! দেখুন, কেমন ছিল দ্রৌপদী ও যশবন্তদের রাজনৈতিক সফর?
রামনাথ কোবিন্দের পর ভারতের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কে? এই নিয়ে জল্পনা চলছিলই৷ বিরোধী দলগুলি তাঁদের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসাবে যশবন্ত সিনহার নাম প্রস্তাব করেছে৷ বিজেপি’র প্রার্থী তালিকায় দুটি নাম নিয়ে চর্চা চলছিল৷ কেরলের রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খান এবং ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন রাজ্যপাল দ্রৌপদী মুর্মু৷ অবশেষে দ্রৌপদীর নামেই সিলমোহর দেয় এনডিএ জোট৷ কিন্তু
কে এই দ্রৌপদী মুর্মু? ১৯৫৮ সালে ২০ জুন ওডিশার ময়ূরভঞ্জ জেলার বাইদাপোসি গ্রামে জন্ম দ্রৌপদী মুর্মুর। বাবার নাম বিরাঞ্চি নারায়ণ টুডু। সক্রিয় রাজনীতিতে আসার আগে ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত ওড়িশা সরকারের জলসম্পদ ও শক্তি দফতরে জুনিয়র অ্যাসিসট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছিলেন দ্রৌপদী। ১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত শ্রী অরবিন্দ ইন্টিগ্রাল এডুকেশন সেন্টারে সাম্মানিক সহকারী শিক্ষিকা ছিলেন।
অন্যদিকে, রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসাবে যশবন্ত সিনহার নাম ঘোষণা হওয়ার আগেই মঙ্গলবার সকালে টুইট করে ‘দেশের বৃহত্তর স্বার্থে’ তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন যশবন্ত৷ দুপুরে বিরোধী জোটের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করা হয় তাঁর নাম৷
যশবন্ত সিনহা কে? ১৯৩৭ সালের ৬ নভেম্বর বিহারে জন্ম যশবন্ত সিনহার। পাটনার স্কুল এবং কলেজেই পড়াশোনা তাঁর। এর পর ১৯৫৮ সালে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন৷ ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপনা করেন। ১৯৬০ সালে ভারতীয় প্রশাসনিক পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত হন৷ বিহার সরকারের অর্থ বিভাগ এবং কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-সহ বিভিন্ন শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন যশবন্ত। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত জার্মানিতে ভারতীয় দূতাবাসে প্রথম বাণিজ্যিক সচিব এবং ১৯৭৩ সালে ফ্রাঙ্কফুর্টে কনসাল জেনারেল নিযুক্ত হন।
দ্রৌপদী-যশবন্ত রাজনৈতিক জীবন: দ্রৌপদী মুর্মূ তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে। কাউন্সিলর হিসাবে রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল তাঁর৷ পরবর্তী সময়ে তিনি রায়রংপুরের উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপার্সন হন৷ ২০০০ এবং ২০০৪ সালে এই রায়রংপুর থেকেই বিজেপি’র টিকিটে দু’বার ভোটে জিতেছিলেন এই আদিবাসী নেত্রী৷ একজন আইএএস অফিসার হিসাবে কেরিয়ার শুরু করা সেই আমলা যশবন্ত সিনহাই ১৯৮৪ সালে জনতা দলের হাত ধরে সক্রিয় রাজনীতির দুনিয়ায় পা রাখেন। ১৯৯০ সালে চন্দ্রশেখর সরকারের অর্থমন্ত্রীও ছিলেন তিনি৷ এর পর গেরুয়া শিবিরের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। জনতা পার্টি ভাঙার পর বাজপেয়ীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি বিজেপি’তে যোগ দেন৷ একসময় বিজেপির মুখপাত্রও ছিলেন যশবন্ত।
দ্রৌপদী-যশবন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ: ওডিশার দু’বারের বিধায়ক দ্রৌপদী মুর্মূ নবীন পট্টনায়েক সরকারের মন্ত্রীও হয়েছিলেন তিনি৷ বিজু জনতা দলের সেই সরকারকে সমর্থন করেছিল ভারতীয় জনতা পার্টি৷ পরিবহণ, মৎস্য এবং পশুপালনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতরের দায়িত্ব সঁপা হয়েছিল তাঁর হাতে৷ ২০০৭ সালে ওডিশার সেরা বিধায়ক হয়েছিলেন তিনি৷ সম্মানিত হয়েছিলেন নীলকণ্ঠ পুরস্কারে৷ এর পর ঝাড়খণ্ডের নবম রাজ্যপাল হিসেবে নিযুক্ত হন দ্রৌপদী৷ তিনিই ঝাড়খণ্ডের প্রথম রাজ্যপাল যিনি পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণ করতে পেরেছিলেন। অন্যদিকে, অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় যশবন্ত সামলেছেন অর্থ এবং বিদেশমন্ত্রকের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব৷ কিন্তু ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহের হাতে দলের রাশ যেতেই বিজেপির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় তাঁর৷ ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের আগে মোদী-শাহের বিরুদ্ধে রীতিমতো প্রচার চালিয়েছিলেন তিনি৷ এর পর ২০২১ সালে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করেন যশবন্ত৷ তিনি ছিলেন দলের সর্বভারতীয় সহ সভাপতি৷ তৃণমূলের সদস্য হলেও কমবেশি প্রায় সব বিরোধী দলের সঙ্গেই সুসম্পর্ক ছিল প্রাক্তন কেন্দ্রীয়মন্ত্রীর।
রাষ্ট্রপতি পদে সংখ্যাতত্ত্বের নিরিখে বেশ খানিকটা এগিয়ে বিজেপি শিবির৷ সবকিছু ঠিকাঠাক থাকলে, এই প্রথম ভারত পেতে চলেছে তার প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতিকে৷ আর খেলা যদি শেষ পর্যন্ত ঘুরে যায়, তাহলে রাষ্ট্রপতি পদে দেশ পেতে পারে একদা বাজপেয়ী ঘনিষ্ঠ, প্রাক্তন বিজেপি নেতা তথা সদ্য প্রাক্তন তৃণমূল নেতাকে৷ এই দুজনের মধ্যে যেই জিতবেন, তিনিই লিখবেন নতুন ভারতে রাজনীতির ইতিহাস!