নিজস্ব প্রতিনিধি: কিছুদিন আগেও যা ভাবা যেত না তা এখন সবার চোখের সামনে ঘটছে। তৃণমূলের অন্যতম শীর্ষ নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায় শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ড তথা বিপুল টাকা উদ্ধারের ঘটনায় ইডির হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলে রয়েছেন। আর কিছুদিন আগে পার্থকে হাসপাতালে শারীরিক পরীক্ষা করাতে নিয়ে যাওয়ার সময় এক মহিলা ক্ষোভের সঙ্গে জুতো ছুঁড়ে মারেন তাঁর দিকে। মাসখানেক আগেও কি এমন ঘটনা ঘটতে পারে সেটা কেউ ভাবতে পেরেছিলেন? আর সেই ঘটনার চর্চার মধ্যেই সোমবার এসএসকেএম হাসপাতালে তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি তথা দোর্দণ্ডপ্রতাপ অনুব্রত মণ্ডলের উদ্দেশে চোর চোর আওয়াজ তুললেন সাধারণ মানুষ।
এদিন হাসপাতালে আগত এক রোগীর পরিজন বলেন, গরু চুরি করে কেউ ধরা পড়লে গ্রামে যেভাবে গাছে বেঁধে চোরকে পেটানো হয় সেরকমই করা উচিত অনুব্রত মণ্ডলকে। তাহলেই বুঝতে পারবেন মজাটা! আরেক রোগীর পরিজনের কথায়, “আমি সাধারণ মানুষ। রোগীর সঙ্গে হাসপাতাল এসেছিলাম। সিবিআই বারবার গরুচোরকে ডেকে পাঠাচ্ছে বলে শুনেছিলাম। সবাই বলছে গরু চোর, তাই আমিও ওনাকে গরু চোর বলেছি।”
অনুব্রতকে গরু চোর বলেই ওই জায়গা থেকে চলে যান ওই ব্যক্তি। ঠিক এই জায়গা থেকেই প্রশ্ন উঠছে ঘটনাগুলি নিয়ে কতটা অস্বস্তির মধ্যে পড়েছে তৃণমূল? সবচেয়ে বড় কথা পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘটনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় চলছে। সকলেই ঘটনার পাশাপাশি তৃণমূলের তীব্র নিন্দা করছেন। মনে রাখতে হবে তাঁদের বড় অংশ সাধারণ মানুষ। তাঁরা কেউ প্রত্যক্ষ ভাবে রাজনীতি করেন না। যে মহিলা জুতো ছুঁড়েছেন, বা যারা অনুব্রতকে চোর বলছেন তাঁরাও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। তবে কী রাজ্যবাসীর একটা বড় অংশ আস্তে আস্তে দুর্নীতি ইস্যুতে তৃণমূলের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছেন? আগামী দিনে পঞ্চায়েত নির্বাচনে এর বড় প্রভাব পড়বে? স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি খুবই ভাবাচ্ছে তৃণমূলকে।
আসলে একুশের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক আসন জিতে ক্ষমতায় আসার পর তৃণমূল গোটা রাজ্যে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। বিরোধীরা রাতারাতি রাজনীতির ময়দান থেকে ভ্যানিস হয়ে যায়। পুরভোট, বিধানসভা বা লোকসভার উপনির্বাচন, সবেতেই তৃণমূলের জয়জয়কার। বিরোধীরা প্রত্যেকটিতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী মডেল-অভিনেত্রী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধারের পর রাতারাতি তৃণমূল সম্পর্কে মানুষের যে কতটা খারাপ ধারণা হয়েছে, তা এসব ঘটনাতেই পরিষ্কার। সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আতস কাচের নিচে গরু পাচার মামলায় বহুদিন ধরেই রয়েছেন অনুব্রত মণ্ডল। যিনি এক দশকের বেশি সময় ধরে তৃণমূলের অন্যতম প্রধান মুখ। অর্থাৎ দুর্নীতি কাণ্ডে তৃণমূলকে জড়িয়ে মানুষ এবার প্রকাশ্যে রি-অ্যাক্ট করছেন। যেটা কিন্তু কয়েক মাস আগেও ভাবা যেত না। সরকারে যে দলই থাকুক না কেন, সাধারণ মানুষ তাদের বিরোধিতা করতে ভয় পান। কিন্তু সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে রাজ্যবাসীর একটা বড় অংশ রাস্তাঘাটে, চায়ের দোকানে, অফিসে, ক্লাবে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় শাসকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।
রাতারাতি তাঁরা অনেক বেশি প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন। সবচেয়ে বড় কথা পরিস্থিতির চাপে পড়ে তৃণমূল সেভাবে বিষয়গুলি নিয়ে পাল্টা কিছু বলতে পারছে না। তবে কি তৃণমূল এটা বুঝতে পারছে বিরোধীরা তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি নিয়ে যে সমস্ত অভিযোগ করছে তার যথেষ্ট ভিত্তি আছে? এই চর্চা যথারীতি শুরু হয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে। তাই পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে জুতো ছুঁড়ে মারা বা এসএসকেএম হাসপাতালে অনুব্রত মণ্ডলকে চোর চোর বলে কটাক্ষ করা নিছক বিক্ষিপ্ত ঘটনা কিন্তু নয়। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেখা যেতে পারে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। আর সেই আশঙ্কা থেকে তৃণমূল আপাতত কিছুটা চুপচাপই রয়েছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিষয়গুলি কোন দিকে মোড় নেয় এখন তারই অপেক্ষা।