কোল্লাম: বিংশ শতকের গোড়ার দিকে যখন সাধারণ বাড়ির মেয়েদের পড়াশোনার বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করাটাও সমাজের চোখে অপরাধ বলে গণ্য করা হতো সেইসময় অদম্য ইচ্ছেশক্তি আর জেদের বশে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন আজকের ১০৫ বছর বয়সী ভাগীরথী আম্মা। ৯ বছর বয়সে তখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়াশোনা করছেন। হঠাৎ মায়ের মৃত্যু তাঁর সমস্ত ইচ্ছের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। ছোট ছোট ভাই বোনদের দেখাশোনার দায়িত্ব এসে পড়ল তাঁর কাঁধে।
'শিক্ষা', 'শিক্ষিত' শব্দগুলো হারিয়ে গেল বাস্তব জীবনের দৈনন্দিনতায়। সংসারের নিত্যদিনের কাজকর্ম আর দায়িত্ব পালনের মধ্যেই হারিয়ে গেল শৈশব। সেই সময়ে মেয়েদের অল্প বয়সেই বিয়ে দেওয়ার নিয়ম ছিল। সমাজের রীতি মেনেই একসময় বিয়েও হয়ে গেল ভাগীরথীর। মাথার ওপর অভিভাবক হিসেবে পেলেন নিজের স্বামীকে। আরও একবার ইচ্ছের ঝাঁপি খুললেন ভাগীরথী। তৃতীয় শ্রেণীতে ফেলে আসা ইচ্ছেটাকে তুলে আনলেন। জেদ চেপে বসল, এবার শিক্ষার অন্তত প্রাথমিক ধাপ তাঁকে উত্তীর্ণ হতেই হবে।
কিন্তু আবারও এক মৃত্যু তাঁর সেই স্বপ্নে যবনিকা পতন ঘটালো। মাত্র ৩০ বছর বয়সে হারালেন একমাত্র অবলম্বন স্বামীকে। তখন কেরলের কোল্লাম জেলার ত্রিক্করুভা পঞ্চায়েতের প্রক্কুলামের বাড়িতে চার মেয়ে ও দুই ছেলের দায়িত্ব তাঁর একার কাঁধে। তবে এরপরেও সমস্ত ইচ্ছেগুলো সযত্নে আগলে রেখেছিলেন ছেলে-মেয়েদের ইচ্ছেপূরণের মধ্যে। জীবনের শতবর্ষ পেরিয়ে এসে এবার তাঁর সেই অদম্য ইচ্ছে আর জেদ পূর্ণতা পেল। ভারতের প্রবীনতম সাক্ষর হিসেবে নজির গড়লেন কেরলের সর্বশিক্ষা অভিযানের ক্লাস ফোরের পরীক্ষায় পাশ করে। পরিবেশ বিদ্যা, গণিত ও মালায়লাম পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ৭৪.৫ শতাংশ নম্বর পেয়েছেন তিনি। পরীক্ষায় বসার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বার্ধক্য।
কিন্তু তার অদম্য ইচ্ছে শক্তির কাছে হার মানে নিয়ম বিধি। অবশেষে বিশেষ অনুমতি নিয়ে বাড়িতে বসেই পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় ভাগীরথী আম্মার জন্য। লেখার জন্য হাতের ক্ষমতা ক্ষয় পেলেও প্রখর স্মরণশক্তি আর ছোটো মেয়ে থাঙ্কমণির সহায়তায় জীবনের শেষ ইচ্ছে পূরণ হল এই বিশেষ সম্মান প্রাপ্তির মধ্যে দিয়ে। সাক্ষরতা মিশন এর এই পরীক্ষায় বসার জন্য ভাগীরথী দেবীকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন আলাপ্পুজা জেলার চেপ্পরের আরও এক বর্ষীয়ান ৯৮ বছর বয়সী কার্থিয়ানি আম্মা। গতবারের সাক্ষরতা মিশনের পরীক্ষায় যিনি ৯৮ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলেন। সাক্ষরতা পরীক্ষায় সাফল্যের পর ভাগীরথী আম্মা এখন কেএসএলএম-এর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর।
যে সংস্থা স্কুল ছুট মেয়েদের নতুন করে পড়াশোনায় উৎসাহ যোগায়। ভাগীরথী দেবীর এই সাফল্যে উচ্ছ্বসিত ত্রিক্করুভা পঞ্চায়েতের সভাপতি কে চন্দ্রশেখর পিল্লাই দেখা করেন তাঁর বাড়ি 'নন্দধাম'-এ গিয়ে। এখন আম্মার একটাই আবেদন, বার্ধক্য অথবা বিধবা ভাতার। আঁধার কার্ড না থাকায় এই সরকারি সুবিধা থেকে এতদিন বঞ্চিত ছিলেন আম্মা। তৃতীয় বিশ্বের যুগেও ভারতের বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে এখনো মেয়েদের পড়াশোনাকে গুরুত্ব দিতে চান না বহু পরিবার। ১০৫ বছর বয়সী এই বৃদ্ধার সাফল্য তাদের কাছে শুধু অনুপ্রেরণাই নয় সাহসিকতার নিদর্শন হয়ে উঠবে।