কলকাতা: দেশের প্রতিরক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে এমন অনেক নায়ক আছেন, যাঁদের নাম হয়তো ইতিহাসের পাতায় লেখা নেই৷ কিন্তু, জাতি গঠনে তাঁদের অবদান লেখা রয়েছে স্বর্ণাক্ষরে। সোনম নোরবুর মতো মানুষ যদি না থাকত, তাহলে বহুদিন আগেই হয়তো পাকিস্তানের দখলে চলে যেত লাদাখ।
আরও পড়ুন- চোখের ভিতরে তেরঙ্গা! শিল্পীর কাণ্ডে তাজ্জব নেটদুনিয়া
১৯০৯ সালে লেহতে নিয়াচু পরিবারে জন্ম সোনম নোরবুর৷ পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ করেন৷ এর পর চলে যান ব্রিটেনে৷ সেখানে ইউনিভার্সিটি অফ শেফিল্ড থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ করেন।
সাল ১৯৪৭। দেশ তখন স্বাধীন৷ কিন্তু, তখনও পাকিস্তানের নজর ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলির উপর৷ ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাস নাগাদ গিলগিট-বালটিস্তানের স্কার্দু শহর চলে যায় পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে৷ নজরে ছিল আরও এক সীমান্ত অঞ্চল লেহ৷ সেই সময় উপজাতীয় হানাদারদের আক্রমণ রুখে দেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল শের জং থাপার নেতৃত্বাধীন বাহিনী। মাত্র ৩৩ জনকে নিয়ে লড়াই করেছিলেন তিনি৷ রক্ষা করেছিলেন লাদাখকে৷
সেই সময় নিজের কর্মজীবনের শীর্ষে রয়েছেন সোনম। প্রতিবারের মতো এবারও দেশমাতৃকাকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসেন তিনি। লাদাখের সামনে যখন বিপদ দাঁড়িয়ে, তখন সেনাবাহিনীর সুবিধার কথা চিন্তা করে এক অভিনব পরিকল্পনা করলেন তিনি।
খারাপ আবহাওয়ার জন্যে লাদাখের পাহাড়ি রাস্তায় সেনাদের যাতায়াত করা সেই সময় প্রায় দুষ্কর ছিল। ফলে লাদাখের উপর আক্রমণ হলে তড়িঘড়ি সেখানে জরুরি সহায়তার জন্য সেনা এবং রসদ পৌঁছনো সম্ভব ছিল না। সেই সময় লাদাখকে রক্ষা করার এক মাত্র উপায় ছিল বিমান পরিষেবা৷ বিমানের মাধ্যমে সেনাদের পৌঁছে দেওয়া হত। কিন্তু, বিমান অবতরণের জন্য লাদাখে কোনও এয়ারস্ট্রিপ বা রানওয়ে ছিল না। সেনা স্বার্থের কথা ভেবেই লাদাখে একটি এয়ারস্ট্রিপ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন সোনম।
১৯৪৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি৷ শ্রীনগর থেকে পায়ে হেঁটে জোজিলা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন ডোগলা রেজিমেন্টের দ্বিতীয় ব্যাটালিয়ন৷ সেই সময় তাঁদের সঙ্গী হয়েছিলেন সোনম। ৮ মার্চ তাঁরা লেহ-তে পৌঁছন। এরপর সেখানে শুরু হয় এয়ারস্ট্রিপ নির্মাণের কাজ। এই প্রকল্প শুরুর তিন সপ্তাহের মধ্যেই ২,৩০০ গজের একটি এয়ারস্ট্রিপ নির্মাণ শেষ করে ফেলেন তিনি। এর জন্য কোনও প্রযুক্তিগত সহায়তা নেননি৷ সঙ্গে করে শুধু নিয়ে গিয়েছিলেন ১৩ হাজার টাকা৷
কোনও রকম যান্ত্রিক সরঞ্জাম ছাড়া শুধু মাত্র কায়িক পরিশ্রম করে ৬ এপ্রিল নাগাদ রানওয়েটি তৈরি করে ফেলেন সোনম৷ লেফটেন্যান্ট জেনারেল এনএস ব্রার জানান, সোনম নোরবু অত্যন্ত সৎ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন৷ লাদাখে ওই বিমানবন্দর তৈরির জন্য তাঁর খরচ হয়েছিল ১০,৮৯১ টাকা৷ অবশিষ্ট টাকা তিনি ফেরত দিয়েছিলেন সরকারের কোষাগারে৷ রানওয়ে তৈরির পরেই সোনম সেনাবাহিনীর কাছে সেই বার্তা পাঠিয়ে দেন৷ যাতে লাদাখে শক্তিবৃদ্ধির জন্য দ্রুত সেখানে বিমান পাঠানো হয়। তাঁর বেতার বার্তা পেয়েই ২৪ মে এয়ার কমোডর মেহর সিং, কো-পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এসডি সিং-সহ জেনারেল থিমাইয়া ডাকোটা বিমানে লেহ-তে অবতরণ করেছিলেন।
এর আগে পর্যন্ত লাদাখের মানুষ জানাতেন না বিমান কী৷ তাঁর হাত ধরেই লাদাখের মানুষ আধুনিকতার ঝলক পান৷ এদিকে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ততক্ষণে লাদাখ-কোনকা পর্যন্ত এগিয়ে এসেছিল৷ লেহ ছাড়া জোজিলা থেকে কার্গিল, খালতসি থেকে নিমু, গোটা এলাকাই ছিল পাক হানাদারদের দখলে৷ খারাপ আবহাওয়ার জন্য এক সপ্তাহ পর ছ’টি ডাকোটা বিমান লাদাখের রানওয়েতে অবতরণ করে। অস্ত্র ও গোলাবারুদ-সহ পৌঁছয় ২/৪ গোর্খা রাইফেলস্৷
পরবর্তীতে, রোটাং পাস দিয়েও সড়কপথে ঢুকতে থাকে ভারতীয় সেনা। জুলাই ও অগাস্ট মাসের মধ্যে শত্রুবাহিনীকে পরাস্ত করে লেহকে রক্ষা করে সেনাবাহিনী। ভারতীয় বাহিনী ‘অপারেশন বাইসন’-এর অধীনে ১৯৪৮ সালের নভেম্বরের মধ্যে জোজিলা এবং কার্গিল পুনরুদ্ধার করে। এর পিছনে সোনম নোরবু অবদান ছিল অনস্বীকার্য।
পরবর্তীতে সোনম জম্মু ও কাশ্মীরের পূর্ত দফতরে যোগদান করেন এবং বর্ডার রোডস অর্গানাইজেশনের চিফ ইঞ্জিনিয়ারও হন। জাতির প্রতি তাঁর এই অবদানের জন্য ১৯৬১ সালে তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে ভারত সরকার।
” style=”border: 0px; overflow: hidden”” title=”YouTube video player” width=”560″>