মুম্বই: দেশ তখন সদ্য স্বাধীন৷ কিন্তু সমাজ ডুবে অন্ধকারের গর্ভে৷ মাথার উপর বাবা-মায়ের আশ্রয় থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র কন্যা সন্তান হওয়ার অপরাধে তাঁকে মানুষ হতে হয় অনাথের মতো৷ ছাড়তে হয় পড়াশোনা৷ শুনতে হয় স্বামীর গঞ্জনা৷ তার পরেও তিনি হার মানেননি৷ বরং অদম্য সাহস আর জেদে হয়ে উঠেছেন ‘অনাথের মা’৷ তিনি অন্য কেউ নন সিন্ধুতাই সপকাল৷
আরও পড়ুন- করোনা নয়, এই কারণে পিছিয়ে গেল পঞ্জাবের বিধানসভা ভোট
গত ৪ এপ্রিল পুণের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সিন্ধুতাই৷ বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। তাঁর মৃত্যুতে আরও একবার অনাথ হল হাজারো শিশু৷ সিন্ধুতাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়েই শোকজ্ঞাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে থেকে শুরু করে সমাজের বহু বিশিষ্টজন। তবে এক দিনে তিনি সমাজের ‘বিশিষ্টদের’ একজন হয়ে ওঠেননি৷ তিল তিল করে লড়াই করে এই জায়গাটা করতে পেরেছিলেন তিনি৷
সিন্ধুতাইয়ের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর মহারাষ্ট্রের ওয়ারধা জেলায় পিম্পরি মেঘে নামে এক অখ্যাত গ্রামে। দেশ স্বাধীন হলেও সেই আলো তখনও পৌঁছয়নি অভিমান সাঠের কুটিরে। ফুটফুটে শিশুকন্যা সন্তানের জন্ম মেনে নিতে পারেনি তাঁর পরিবার। কারণ সে যে মেয়ে! ফলে বাবা মা থাকলেও সিন্ধুতাইকে বড় হতে থাকে অনাথের মতোই৷ এমনকী ভাইবোনদের কাছেও সে হয়ে উঠেছিল অবহেলার পাত্রী৷ তাঁর ডাকনাম হয়ে উঠেছিল ‘ন্যাকড়া’৷
সিন্ধুতাইয়ের বাবা অভিমান সাঠে গরু চলিয়ে সংসার চালাতেন৷ ফলে অভাব ছিল চিরসঙ্গী৷ তা সত্ত্বেও মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন অভিমান৷ কিন্তু যে সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় সেই সংসারে মেয়ের পড়াশোনার জন্য খরচ বিলাসিতা৷ সিন্ধুতাইয়ের পড়াশোনার বিরোধিতা করেন তাঁর মা৷ স্ত্রীর পরামর্শ মেনে মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ করেন অভিমান৷ সিন্ধুতাই তখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী৷ অগত্যা শুরু হয় পাত্রের খোঁজ৷ ১০ বছরের সিদ্ধুতাইয়ের জন্য পাত্রও খুঁজে ফেলেন তাঁর বাবা৷ পাত্র বছর ৩০-এর শ্রীহরি সপকাল৷ ২০ বছরের বড় পাত্রের হাতে মেয়েকে তুলে দিয়ে দায় সারেন তাঁর বাবা মা৷
বাবা-মায়ের আশ্রয় ছেড়ে সিন্ধুতাইয়ের ঠাঁই হয় শ্রীহরির ঘরে৷ ২০ বছরের মধ্যে ৩ সন্তানের মা তখন সিন্ধুতাই৷ তবে স্বামীর ঘরের সুখ বেশি দিন ঠাঁই হয়নি তাঁর৷ গ্রামের কর্তাব্যক্তিদের অপমান করার অপরাধে শ্রীহরির কানে মন্ত্রণা দিতে শুরু করলেন তাঁরা৷ সেই মন্ত্রণা শুনে স্ত্রীর দিকে আঙুল তুললেন খোদ তাঁর স্বামী৷ সিন্ধুতাই তখন ন’মাসের অন্তঃসত্ত্বা৷ সেই অবস্থায় মারধর করে তাঁকে বাড়ি থেকে বার করে দিলেন শ্রীহরি৷ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার দিনেই একটি গোয়ালে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন সিন্ধুতাই৷ কিন্তু কী ভাবে মানুষ করবেন সদ্যোজাত সন্তানকে৷ সেই চিন্তা নিয়েই ঠাঁই নেন স্টেশনে৷ সেখানে সারাদিন ভিক্ষ করার পর মেয়ে কোলে শ্মশানে চলে আসতেন সিন্ধুতাই৷
স্টেশনে ভিক্ষাবৃত্তির সময় বহু অনাথ শিশুকে একই কাজ করতে দেখতেন সিন্ধুতাই। তখন থেকেই তাদের জন্য কিছু একটা করার চিন্তা তাঁকে তাড়া করতে থাকে৷ অনাথ শিশুদের কী ভাবে আশ্রয় দেওয়া যায় তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেন তিনি। কিন্তু ভাবলেই তো আর হয় না৷ সেই ভাবনাকে বাস্তবায়িত করাটা সহসসাধ্য ছিল না৷
কিন্তু অদম্য মনোবল নিয়ে নিজের রোজগারের টাকায় একটি অনাথ আশ্রম গড়ে তোলেন সিন্ধুতাই। অমরাবতী জেলার পাহাড়ি এলাকায় চিখলদরায় অনাথ শিশুদের জন্য প্রথম আশ্রমটি খোলেন তিনি। সেটাই ছিল সূচনা৷ এর পর সারা জীবনে সহস্র অনাথের আশ্রয়দাতা হয়েছেন সিন্ধুতাই। অনাথআশ্রম গড়ে তোলার পর ঘরহারাদের দেখাশোনা করার জন্যে নিজের সংস্থাও খোলেন সিন্ধুতাই। চিখলদরায় ভবঘুরে নাবালিকা-কিশোরীদের নতুন ঠিকানা হয় ‘সাবিত্রীবাই ফুলে গালর্স হস্টেল’। উল্লেখ্য এটিই ছিল সিন্ধুতাইয়ের প্রথম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
প্রথাগত শিক্ষা শেষ করতে পারেননি সিন্ধুতাই৷ তবে ছোট থেকেই গুছিয়ে কথা বলার দক্ষতা ছিল তাঁর৷ এক বার তিনি বলেছিলেন, ‘‘খিদের জ্বালায় মুখে কথা ফুটে গিয়েছে।’’ মানুষজনের সঙ্গে কথা বলার ক্ষমতা, যোগাযোগের দক্ষতা, তাঁর জীবনে বড় ভূমিকা নিয়েছিল। একে একে ন’টি সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন ‘অনাথের মা’৷
সারা জীবনে প্রায় ১,৪০০ জন অনাথ শিশুর আশ্রয়দাত্রী হয়ে উঠেছিলেন৷ শুধু তাই নয়, সরকারি প্রকল্পের জন্য জমিহারাদের পাশেও দাঁড়িয়েছিলেন৷ সোচ্চার হয়েছিলেন তাঁদের হয়ে৷ অমরাবতীতে ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্পের জন্য ৮৪টি গ্রামের আদিবাসীদের উচ্ছেদের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তার বিরোধিতায় সরব হয়েছিলেন সিন্ধুতাই৷
তাঁর এই লড়াকু কর্মজীবন তাঁকে একাধিক সম্মান, শিরোপা এবে দিয়েছিল। তাঁর জীবন কাহিনী নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র৷ ২০১০ সালে রুপোলি পর্দায় মুক্তি পায় মারাঠি ফিল্ম ‘মি সিন্ধুতাই সপকাল’। যা লন্ডন ফিল্মোৎসবে নমিনেশনও পায়৷ ২০২১ সালে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিত হন সিন্ধুতাই৷