নয়াদিল্লি: 'নতুন ভারত' গড়ার লক্ষ্যে যেখানে সাধারণ মানুষের সমস্ত পরিষেবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে করে তোলার জন্য একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে দেশের সরকার। অথচ এই সাধারণ মানুষের জীবন ধারণের প্রধান ভরসা ব্যাঙ্কে জমানো টাকায় যথেচ্ছভাবে ভাগ বসাচ্ছে সাইবার ক্রিমিনালরা। বলা যায় এযেন 'প্রদীপের নিচেই আঁধার'।
সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পেশ করা একটি তথ্য থেকেই প্রকাশ্যে এলো বিগত কয়েক বছরে দেশের সাইবার ক্রাইমের এই ভয়াবহ চিত্র। তথ্য অনুসারে ১লা অক্টোবর, ২০১৯ থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯ এর মধ্যে মাত্র ৯২ দিন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড এবং নেট ব্যাঙ্কিংয়ে জালিয়াতি করে প্রায় ১২৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সাইবার ক্রিমিনালরা। তথ্য বলছে এই সময়ের মধ্যে তফসিলী ব্যাংকগুলি প্রতি মিনিটে ছটি করে মামলা দায়ের করেছে, যার মধ্যে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত শেষ ত্রৈমাসিকে মোট ২১,০৪১ টি বড়সড় জালিয়াতি মামলার রেকর্ড রয়েছে।
এর মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক জালিয়াতির ঘটনা এটিএম / ডেবিট কার্ড সংক্রান্ত। যেখানে ১১,০৫৮ টি ঘটনায় জালিয়াতি করে হাতিয়ে নেওয়া টাকার পরিমাণ ছিল ৯৪.৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে আছে ৬,১১৭টি ক্রেডিট কার্ড থেকে ১৯.৭ কোটি টাকা এবং ৩,৮৬৬টি নেট ব্যাঙ্কিং থেকে ১৩.৭ কোটি টাকা। এর আগে ১লা এপ্রিল, ২০১৯ এবং ৩০সেপ্টেম্বর, ২০১৯ এর মধ্যে ব্যাংকগুলির ১০১ কোটি টাকা লোকসানের কথা জানিয়েছিল। অর্থাৎ, ১লা এপ্রিল, ২০১৯ থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯ এর মধ্যে এই নমাসে মোট ২৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সাইবার ক্রিমিনালরা।
তবে গত একবছর নয়, তথ্যে মারাত্মকভাবে উঠে এসেছে এর আগের দু’বছরে ক্রমাগত ঘটে চলা এই ধরনের ঘটনার তথ্য, যেখানে এই এটিএম বা ডেবিট কার্ড এবং নেট ব্যাঙ্কিংয়ের মাধ্যমে মোট ৩১৮.৪ কোটি টাকা জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। সেই অনুযায়ী ১লা এপ্রিল ২০১৭ থেকে ৩১ মার্চ ২০১৯ এর মধ্যে হাতিয়ে নেওয়া টাকার পরিমাণ ছিল ৫৪৭ কোটি টাকা। যা এই সময়ের মধ্যে ১.১ লক্ষেরও বেশি সাইবার ক্রাইমের মাধ্যমে চুরি করে নেওয়া হয়েছে।
সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকের আগে ইতিমধ্যেই ১লা জানুয়ারী, ২০২০ থেকে এপর্যন্ত মোট ১১,০৪৪ টি এই ধরণের সাইবার ক্রাইমের ঘটনা ঘটে গেছে যেখানে ১২.৮ কোটি টাকা খোয়া গেছে। শেষ তিন মাসের তথ্য মার্চের শেষেই নিশ্চিত করবে আরবিআই। সাইবার বিশেষজ্ঞদের মতে এই ধরনের চুরির ঘটনা বেশিরভাগটাই কার্ড স্কিমিং-এর মাধ্যমে ঘটানো হয়েছে। যেখানে জালিয়াতরা এটিএম-এ আসল কার্ড রিডারের ওপর নকল একটি কার্ড রিডার জুড়ে দিয়ে কার্ডের সমস্ত তথ্য হাতিয়ে নিয়েছে। এটিএম স্কিমারগুলি বিভিন্ন আকার এবং মাপের হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কয়েকটি মূল উপাদান থাকে – যেমন ব্রোশিওর র্্যাকের মধ্যে লুকানো একটি ছোট স্পাই ক্যাম, বা নকল পিন প্যাড ওভারলে। তবে এইধরণের জালিয়াতদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, কোনো এটিএম-এর স্কিমার কিটে যত বেশি উপাদান অন্তর্ভুক্ত থাকে, এটিএম-এ এই ধরণের ডিভাইসগুলি সংযুক্ত করা বা সরিয়ে দেওয়ার সুযোগ তত বেশি।
সুতরাং, সাইবার বিশেষজ্ঞদের মতে এটিএম-এ 'অল ইন ওয়ান' স্কিমার রাখতে হবে যেখানে সমন্বিত একটি ম্যাগনেটিক স্ট্রাইপ রিডার ব্যবহার করে কার্ডের সমস্ত তথ্য জমা রাখবে এবং এর সঙ্গেই বিশেষ পদ্ধতিতে একটি হিডেন ক্যামেরা যুক্ত থাকবে। ফলে কোনও সাধারণ গ্রাহক যখন তার ব্যাঙ্কের কার্ডটি স্লাইড করবে তখন এই বিশেষ মেশিন সেই কার্ডের পিনের ক্রমটি রেকর্ড করে রাখতে পারবে।
সাইবার ক্রিমিনালদের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অন্যান্য উপায়গুলির হলো ফিশিং, ব্যাংক সার্ভার হ্যাকিং (নেট ব্যাংকিং জালিয়াতির জন্য) এবং সোস্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (যেখানে গ্রাহকদের নানাভাবে বিভ্রান্ত করে আলোচনাযর মাধ্যমে সমস্ত তথ্য জেনে নেওয়া হয়)। আর্থিক দৈন্যতা কাটিয়ে উঠতে যেখানে প্রতিদিন একটু একটু করে কমে ব্যাঙ্কগুলোতে সুদের হার প্রায় তলানিতে ঠেকেছে, সেখানে পাল্লা দিয়ে সাইবার ক্রাইমের মাধ্যমে ব্যাঙ্ক জালিয়াতি এই রমরমা যে অদূর ভবিষ্যতে মানুষকে পুরোপুরি ব্যাঙ্ক বিমুখ করে তুলবেনা সেটাই এখন মূল্যবান প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইসঙ্গে সরকারের ঘরে সঞ্চিত অর্থ থেকে সুবিধা তো দূরস্ত তার নিরাপত্তা নিয়েও যে কোনো নিশ্চয়তা নেই সাধারণ মানুষের মধ্যে সেই চিন্তা ভাবনাও এখন জোরালো হচ্ছে।