নয়াদিল্লি: করোনা আতঙ্কে লকডাউনের জেরে দেশের জনসাধারণের যখন ঘরবন্দী দশা। তখন বাড়ি ফিরতে মরিয়া কর্মসূত্রে ভিনরাজ্যে থাকা শ্রমিক-দিনমজু্রেরা। দেশ জুড়ে কমবেশি সব রাজ্যেই একই পরিস্থিতি। কিন্তু এই লকডাউনের মধ্যেই বাড়ি ফেরার তাড়ায় শনিবার দিল্লি-উত্তরপ্রদেশ সীমান্তের আনন্দবিহার বাস টার্মিনাসের যে চিত্রটা চোখে পড়ল তা ছিল সম্পূর্ণ বীপরীত এবং অবশ্যই নজিরবিহীন। সমস্যা যেখানে করোনা সংক্রামণ, সেখানে কোথায় স্যোশাল ডিস্ট্যান্সিং? আর কোথায়ই বা সুরক্ষিত থাকার জন্য অন্যান্য আনুষঙ্গিক উপকরণ? করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে নিজেদের ঘরে ফিরতে মরিয়া শয়ে শয়ে শ্রমিকের দল কার্যত সেই আতঙ্ককেই উপেক্ষা করে নিজেদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে ভিড় করেন আনন্দবিহার বাস টার্মিনাসে। ইতিহাসের পাতায় দেখা যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ বা দেশভাগের মত বিভিন্ন আপৎকালীন পরিস্থিতিতে দেশান্তরে পালিয়ে বাঁচার সেই দৃশ্যগুলো যেন তাজা হয়ে উঠল।
“সরকার আমাদের খাবার ব্যবস্থা করলে আমাদের এভাবে চলে যেতে হতোনা। ” এমনটাই অভিযোগ শ্রমিকদের। আর তাই তাদের কাছে এখন করোনার থেকেও বেশি আতঙ্কের হয়ে উঠেছে খিদের জ্বালা। লকডাউনের জন্য স্থানীয় গণপরিবহন মাধ্যগুলি বন্ধ থাকায় তাই হয়তো মাইলের পর মাইল দল বেঁধে পায়ে হেঁটে বাস ধরতে এসেছেন বহু মানুষ। মহিলা-শিশু সবাইকেই চোখে পড়ছে এই ভিড়ে। এইমূহুর্তে করোনা কবলিত কোনো দেশের এমন দৃশ্য শুধুমাত্র মে দেশের গৃহবন্দী মানুষকে হতবাক করবে তাই নয়, বরং বিশ্বের করোনা কবলিত দেশগুলিকেও অবাক করে দেবে তা বলাই বাহুল্য।
ভিনরাজ্যের শ্রমিকদের ঘরে ফেরাতে ১০০০ বাসের ব্যবস্থা করেছিল উত্তরপ্রদেশ সরকার। পাশাপাশি, দিল্লি সরকারও ব্যব্স্থা করেছিল ১০০ বাসের। হরিয়ানা,রাজস্থান, বিহার, উত্তরপ্রদেশের কয়েক হাজার শ্রমিক সেইসব বাস ধরার জন্যই ভিড় জমান বাস টার্মিনাসে।ইউপি সরকারের এক নির্দেশিকায় বলা হয়েছিল, রাজ্যগুলিতে লকডাউনের কারণে দিল্লিতে আটকে পড়া উত্তরপ্রদেশের শ্রমিকদের ফেরানোর ব্যবস্থা করবে উত্তরপ্রদেশ সরকার। বলা হয়েছিল, বাসগুলি ছাড়বে দিল্লির আনন্দ বিহার বাস টার্মিনাস থেকে। এই সংক্রান্ত তথ্য জানতে যাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট ফোন নম্বরও দেওয়া হয়েছিল। সতর্ক করা হয়েছিল প্রশাসনকেও।
এমনকি উত্তরপ্রদেশ রাজ্য সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন (ইউপিএসআরটিসি) সমস্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (ডিএম) উচ্চপদস্থ পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্টস (এসএসপি) সহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের অনুরোধ করা হয়েছে যে, দিল্লি ও সংলগ্ন সীমান্ত অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় আটকে পড়া শ্রমিকদের জন্য ২০০ টি বিশেষ বাস চলাচলে যেন কোনো বাধা না দেওয়া হয়।সব ব্যবস্থাই যখন ছিলো। তখন বাসস্ট্যান্ড থেকে বহুদূরে থাকেন যারা, তাঁরা পায়ে হেঁটে বাসস্ট্যান্ডে এলেন কেন? ন্যূনতম পরিবহন ব্যবস্থাও করা গেলনা তাদের জন্য?
আরও ভয়ঙ্কর চিত্র ছিল বাসের ভিতরে। যে বাসে ৫০-৬০ জনের বসার কথা সেখানে উঠে পড়েন ১০০ জনেরও বেশি মানুষ। বাসের ভিতরে জায়গা না পেয়ে ছাদেও উঠে পড়েন অনেকে। প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে গেল কেন? যদিও এখন সে প্রশ্ন যথারীতি অর্থহীন।আসলে এই শ্রমিকদের অধিকাংশেরই আয় এখন বন্ধ। ফলে গ্রামে ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায়ও তো নেই। করোনার থেকেও বেশি চিন্তা তাই না খেয়েই মরার। যদিও সরকারের তরফে ভিনরাজ্যে এই আটকে পড়া শ্রমিকদের জন্য বিশেষ স্কিমের আওতায় খাবার সহ অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অন্য রাজ্যে আটকে পড়া শ্রমিক,কর্মচারীদের থাকা খাওয়া সহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলা সহ অন্যান্য রাজ্যগুলিও একে অপরের কাছে আবেদন জানিয়েছে। একই আবেদন জানিয়েছে উত্তরপ্রদেশ সরকারও।
#WATCH Huge number of people seen walking on foot toward their homes in different districts of Uttar Pradesh, at Ghazipur near Delhi-UP border in absence of transport services due to #CoronvirusLockdown. pic.twitter.com/k7mJxRK1QO
— ANI (@ANI) March 27, 2020
কিন্তু আনন্দবিহার টার্মিনাসে দাঁড়িয়ে এক শ্রমিক এএনআই-কে জানিয়েছেন তাঁদের দুরবস্থার কথা। তাঁর মতে,” আমরা সরকারের নির্দেশ মান্য করি, কিন্তু খাবার জুটবে কোথা থেকে? সরকার আমাদের খাবার ব্যবস্থা করলে আমাদের এভাবে চলে যেতে হতোনা। এছাড়াও আলাদা করে একা থাকার মত ঘর কোথায় আমাদের?” তিনি আরও বলেন,”গ্রামে ফিরে গেলে সেখানে পরিবারের পাশে অন্তত একজনকে পাওয়া যাবে এবং খাবারের জন্য চিন্তা করতে হবেনা।” আরও এক শ্রমিক জানিয়েছেন অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতার কথা, দোকানে যখন রেশন দেওয়া হচ্ছিল তখন তাঁকে সেই রেশন দিতে অস্বীকার করে দোকানদার। কারণ তাঁকে দেখে নাকি স্বাস্থ্যবান বলে মনে হয়েছে ওই দোকানদারের। অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ওই শ্রমিক নিজের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেছে, ” আমার কি পেট নেই? আমি কি না খেয়ে মরব? আমরা কার কাছে অভিযোগ জানানো, যেখানে আমাদের অভিযোগ শোনার মতো কেউ নেই? ঘর ভাড়ার জন্য বাড়ির মালিক বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।”
শুক্রবারও বাড়ি ফেরার জন্য এই একইরকম ভিড় ছিল গাজিয়াবাদের কৌশাম্বি বাসস্ট্যান্ডে। সরকারের বিশেষ ব্যবস্থা, প্যাকেজ,সতর্কতা, সচেতনতা- সরকারের সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ করে দিল এই বিশাল সংখ্যক শ্রমিকদের জমায়েত। মা করোনা সংক্রামণ প্রতিরোধের প্রধান উপায়। তই বলাই যায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে ওঠা প্রশ্নগুলো আরও জোরদার হল।