নয়াদিল্লি: ১৯৬২ সাল৷ ভারতের পূর্ব সীমান্তের বিভিন্ন সেক্টরে রণদামামা বাজিয়ে ভারতের উপর আক্রমণ হেনেছিল আগ্রাসী চিন। শুরু হয়েছিল এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম৷ ভারত-চিনের এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ নিয়ে অনেক সিনেমাও তৈরি হয়েছে৷ কিন্তু চাপা থেকে গিয়েছিল এক বীর সেনার কাহিনী৷ যিনি একাই ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিলেন চিনা ফৌজের৷ ৭২ ঘণ্টা একা একটি পোস্ট আগলে রেখেছিলেন তিনি৷ সেই বীর সৈনিক রাইফেলম্যান যশবন্ত সিং রাওয়াতের জীবন নিয়েই তৈরি হয়েছে ‘৭২ আওয়ার্স’৷ রণক্ষেত্রে একার হাতে ৩০০ চিনা সেনাকে খতম করেছিলেন বীর সৈনিক যশবন্ত সিং রাওয়াত৷
১৯৬২ সালের ১৭ নভেম্বর৷ পূর্ব হিমালয়ের চূড়ায় সূর্যের আলো পড়তেই অরুণাচল প্রদেশে আতর্কিতে হামলা চালিয়েছিল চিনের লাল ফৌজ৷ এর আগেও বেশ কয়েকবার হামলা চালিয়েছিল চিন৷ কিন্তু এইবার লড়াইটা ছিল অনেক কঠিন৷ তাঁদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ৪ নং গাড়োয়াল রেজিমেন্টের রাইফেলম্যান যশবন্ত সিং রাওয়াত৷ টানা ৭২ ঘণ্টা একা একটি পোস্ট আগলে রেখেছিলেন তিনি৷ তিনটি বাঙ্কার থেকে টানা ফায়ারিং করেন চিনা সেনাদের উপর৷ খতম করেন ৩০০ চিনা সৈনিককে৷ হাজারের বেশি চিনা সেনাকে একা ঠেকিয়ে রেখেছিলেন যশবন্ত৷ আর এই ৭২ ঘণ্টায় চিনকে জবাব দেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলেছিল ভারতীয় সেনা৷ শেষ পর্যন্ত যশবন্তের কৌশল বুঝে ফেলে চিন৷ ঘিরে ফেলে যশবন্তকে৷
তাঁর গায়ে এসে বেঁধে শত্রুপক্ষের বুলেট৷ কিন্তু ধরা দেননি তিনি৷ রাইফেলের শেষ গুলিতে নিজেকে শেষ করে দেন এই বীর জওয়ান৷ মরোণত্তর মহাবীরচক্র দেওয়া হয় তাঁকে৷ স্থানীয়দের কাছে তিনি ঈশ্বর স্বরূপ৷ যে জায়গায় যশবন্ত শহিদ হয়েছিলেন তাঁর নাম যশবন্তগড়৷ সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে একটি মন্দির৷ এখনও ভারতের পূর্বপ্রান্ত আগলে রাখে ৪ নং গাড়োয়াল রেজিমেন্ট৷ সেখানে আজও তাঁর ঘর পাহারা দেয় ৪ নং গাড়োয়াল রেজিমেন্টের পাঁচ জওয়ান৷ প্রদর্শিত হয় তাঁর জিনিস৷ তাঁর জুতো প্রতিদিন পালিশ করা হয়৷ শুভাকাঙ্খীদের লেখা চিঠি প্রতিদিন যশবন্তের সামনে রাখা হয়৷ পরের দিন আবার তা সরিয়ে নেওয়া হয়৷
ভারতীয় সেনা যুদ্ধের আঁচ পেয়ে তাওয়াং থেকে ৪ নং গাড়োয়াল রাইফেলসকে সরিয়ে আনে সেলাতে৷ এই পদক্ষেপ ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ৷ কারণ এর আগেও স্থানীয় মনপা উপজাতির বেশে ভারতে ঢোকার চেষ্টা চালিয়েছিল চিন সেনা৷ অনেক ক্ষতিও করে গিয়েছিল৷ কিন্তু সফল হয়নি৷ এর পর একই দিনে পর দু’বার হামলা চালায় চিন৷ সেইবার হামলা চালায় আর্টিলারি, মর্টার এবং মিডিয়াম মেশিনগান (এমএমজি) নিয়ে৷ কিন্তু মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকে ভারতীয় জওয়ানরাও৷ চতুর্থ হামলায় বাবা যশবন্ত সিংয়ের মুখোমুখি হয় লাল ফৌজ৷ এটাই ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হামলা৷ তিন দিক থেকে আক্রমণের মুখে পড়েছিল ৪ নং গাড়োয়াল রাইফেল৷
চিনা সেনার মিডিয়াম মেশিনগানের দাপটে, ৪ নং গাড়োয়াল রেজিমেন্টের লাইট মেশিনগানগুলি চালাবার সুযোগ মেলেনি । চিনা আক্রমণের মুখে কয়েকজন শহিদ হওয়ার পর সাময়িকভাবে পিছিয়ে আসতে বলা হয়েছিল ভারতীয় জওয়ানদের৷ কিন্তু তাঁরা পিছিয়ে আসেনি৷ তবে শোনা যায়, লেন্স নায়েক ত্রিলোক সিং, রাইফেলম্যান যশবন্ত সিং এবং রাইফেলম্যান গোপাল সিং একটি আত্মঘাতী মিশন নিয়েছিল৷ শক্রুপক্ষের ভারী গোলাবর্ষণের মধ্যে পাহারের কোলে ঝোপঝাড়ের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে চিনা বাহিনীর মিডিয়াম মেশিন গান ছিনিয়ে এনেছিল তাঁরা৷ আহত চিনা সেনাদের মেশিনগান ছিনিয়ে নেন যশবন্ত৷ এরপর সফল ভাবেই ফিরে এসেছিলেন নিজেদের বাঙ্কারে৷
শেষ পর্যন্ত একা লড়েছিল যশবন্ত সিং৷ তাঁর সঙ্গে ছিল স্থানীয় দুই মনপা যুবতী৷ নুরা আর সেলা৷
এই দুই বোন যশবন্তকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন৷ যশবন্তকে ফেলে যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়েননি তাঁরাও৷ দুই বোন ক্রমাগত রাইফেলের ম্যাগাজিন লোড করতে থাকে৷ আর একা তিনটি বাঙ্কার থেকে গুলি চালাতে থাকেন যশবন্ত সিং৷ এই কৌঁশলে ধোকা খায় চিনা ফৌজ৷ তারা ভাবে তিনটে বাঙ্কারেই ভারতীয় সেনা মজুত রয়েছে৷ ইতিমধ্যে যশবন্ত সিংকে খাবার জোগান দিতেন যে ব্যক্তি, তাঁকে আটক করে ফেলে চিন সেনা৷ তাঁর কাছ থেকেই লাল ফৌজ জানতে পেরে যায় তিনটি বাঙ্কার মিলিয়ে মাত্র একজন ভারতীয় জওয়ান আছেন। তিনি একাই তিনটি বাঙ্কার ঘুরে ঘুরে নিপুণ নিশানায় নিকেশ করছে চিনা সেনাদের।
এর পরেই ভারতীয় বাঙ্কারে দিকে ১২ জন কম্যান্ডোকে পাঠায় চিন৷ রাতের অন্ধকারে তাঁরা এগিয়ে আসে৷ ভোর হতেই অতর্কিতে হামলা চালায় যশবন্ত, সেলা আর নুরার দিকে৷ গুলি লাগে সেলার মাথায়৷ গ্রেনেডের স্প্লিন্টার আহত হন যশবন্ত৷ কিন্তু তখনও থামেনি তাঁর রাইফেল৷ এক সময় দেখে একটি মাত্র গুলি অবশিষ্ট আছে৷ ধরা পড়ার আগে সেই গুলি দিয়েই নিজেকে শেষ করে দেন যশবন্ত সিং রাওয়াত৷ দীর্ঘ লড়াইয়ের পর মারা যান ২১ বছরের এই বীর জওয়ান৷ পরে নুরাকেও ধরে ফেলে চিনা সেনা৷ অত্যাচার চালানোর পর তাঁকেও মেরে ফেলা হয়৷