নয়াদিল্লি: একটি দেশ সামরিক দিক থেকে ‘ভয়ঙ্কর ভুল’ কখন করে? উত্তর যখন তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে পিছনের দিকে না তাকিয়েই। অনেকেই হয়ত ভাববেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের কথাই বলা হবে। কারণ, এই মুহূর্তে দেশ যখন কোভিড-১৯ এবং বেসামাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারত কী যুদ্ধ হজম করতে পারে। উত্তর – 'না'। যুদ্ধকে উৎসাহিত করার কোনও প্রশ্নই নেই। কিন্তু, চিন কী এই যুদ্ধ হজাম করতে পারবে? কোনও সন্দেহ নেই ভারতের থেকে সামরিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কয়েকগুণ এগিয়ে রয়েছে চিন? তবে, চিনের অভ্যন্তরীন সমস্যাও যে ভারতের থেকে কয়েকগুণ বেশি। এই মুহূর্তে সীমানা ভারতের সঙ্গে সীমিত যুদ্ধ হজম করার মত ক্ষমতা নেই চিনের।
খুব সহজ কথায় প্রথমেই বলি, লাদাখে বিশাল বাহিনী মোতায়েন করা চিনের পক্ষে এই মুহূর্তের অসম্ভব। কারণ, চিনা সেনা অন্য জায়গায় ব্যস্ত রয়েছে। নিজের দেশেই যুদ্ধের মুখোমুখি চিন। বহু দেশ চিনকে রক্তচক্ষু দেখাচ্ছে। যুদ্ধের জন্য একটি দেশের সব থেকে বেশি যা প্রয়োজন, তা হল খুব তাড়াতাড়ি বেশি সংখ্যক সেনাকে সীমান্তে পৌঁছে দেওয়া। এই মুহূর্তের চিনের পক্ষে তা সম্ভব নয়। চিনের স্থল সেনা, নৌ-বাহিনী এবং বায়ুসেনা তাইওয়ান নিয়ে চরম ব্যস্ত। চিনের বায়ুসেনা নিরন্তর তাইওয়ানের আকাশে উড়তে চেষ্টা করছে। নৌ-সেনা দক্ষিণ-চিন সাগরের দখলদারি রক্ষা করতে ব্যস্ত। দক্ষিণ-চিন সাগরে ছয়টি দেশের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে চিন – তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স, ব্রুনেই, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া। চিন সেনা দক্ষিণ-চিন সাগরে কৃত্তিম দ্বীপ তৈরি করেছে। সেখানে সেনা যুদ্ধাভ্যাস করছে। এইখানেই শেষ নয়, পূর্ব-চিন সাগরে জাপানের সঙ্গেও ঝামেলা বাধিয়েছে চিন। চিনা যুদ্ধ জাহাজ কিছুদিন আগে জাপানের জলসীমায় প্রবেশ করে। চিনকে শিক্ষা দিতে সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে জাপান। তবে, বেজিংয়ের সব থেকে বড় চিন্তা হংকং। ভারতের সঙ্গে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে হংকং-য়ের পরিস্থিতি আরও উত্তাল হোক, এমন কখনই চাইবে না বেজিং।
বেজিংয়ের ঘরেও আগুন লেগেছে। তিব্বত কাঁটা এখনও গলায় বিঁধে রয়েছে। তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত। কিন্তু, সেন্ট্রাল তিবেটিয়ান এডমিনস্ট্রেশন'কে সমর্থন করে ভারত। কিছুদিন আগেই তিব্বতের প্রেসিডেন্ট লাবসং সাঙ্গে ভারতে এসেছিলেন। মঙ্গোলিয়ার একটি অংশকে (আউটার মঙ্গোলিয়া) একত্রিত করতে চাইছে চিন, জিংজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছে চিন সেনা, এছাড়া করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় আক্রমণ ইতিমধ্যেই ভাবাচ্ছে বেজিং'কে।
আর্থিকভাবে ভারত এবং চিন – কোনও পক্ষই আজ যুদ্ধ আহ্বান করতে পারে না। যেহেতু চিন নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে, সেই জন্য, চিনের সংখ্যাতত্বই তুলে ধরতে চাইব। ২০২০ সালের প্রথম ত্রৈরাশিকে (1st Quarter of 2020) চিনের জিডিপি ২.৯১ ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়ে। ৬.৯ শতাংশ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে (Year on Year)। উহান-করোনা ভাইরাসের পর বিভিন্ন সংস্থা চিন থেকে পালাচ্ছে। অনেকেই ইউনিট গুটিয়ে নিয়েছে। চিনের উৎপাদন শিল্প ভেঙে পড়েছে। চাহিদা কমেছে। রপ্তানি ৮.৫ শতাংশ কমে গিয়েছে। সর্বোপরি, চিন জুড়ে বেড়েছে বেকাতত্ব। উহান-করোনা ভাইরাস কেলেঙ্কারির পর চাকরি হারিয়েছে আম জনতা। এই পরিপ্রেক্ষিতে সীমান্ত যুদ্ধ চিনের জন্য দুঃস্বপ্ন হতে পারে।
তবে চিন ইতিমধ্যেই আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া'র সঙ্গে বাণিজ্য-যুদ্ধে লিপ্ত। ২০১৯ এর প্রথম অর্ধে আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধে ৩৫ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে চিনের। কম্পিউটার এবং অফিস-যন্ত্রপাতিতে চিনের ব্যাবসা ক্ষতির মুখে। আমেরিকার সাথে এবার কী ভারতের বাজারও খোয়াতে চায় চিন? ভারত ৭২.৭৪ বিলিয়ন ডলারের চিনা দ্রব্য রপ্তানি করে। চিন হয়ত এতটাও নির্বোধ হবে না।
কার ভরসায় ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করবে চিন? পাকিস্তান এবং নতুন বন্ধু নেপাল? অন্যদিকে, কূটনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে সাহায্য করার মত বন্ধুর সংখ্যা ভারতের কম নেই। উহান করোনা ভাইরাস প্রশ্নে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যরা প্রায় সকলেই চিনের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত। একমাত্র রাশিয়ার সমর্থন রয়েছে চিনের দিকে। কিন্তু, প্রশ্ন যখন ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ, সেই সময় পুরোন বন্ধু ভারতের পাশেই যে রাশিয়া থাকবে, তা নিয়ে সন্দেশের অবকাশ নেই। ভারত-চিন যুদ্ধ শুধু দুই দেশের মধ্যেই হওয়ার সম্ভাবনা কম। পৃথিবীর বিভিন্ন শক্তি এতে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য। কারণ, ভারতের বাজার অর্থনীতিতে বিভিন্ন দেশের উৎসাহ রয়েছে। সেক্ষেত্রে, বাড়তি লাফালাফি করার উৎসাহ হারাবে পাকিস্তান।
লাদাখে একটি গুলি চালানোর আগে চিন ভাববে, অর্থনীতি, অভ্যন্তরীন রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির কথা। চিন জানে, ১৯৬২ যুদ্ধ জয়ের কথা ভেবে ঢেকুর তোলাটা দিন শেষ। ১৯৬৭ সালে নাথু-লা এবং চো-লা'তে ভারতীয় সেনার হাতে চরম পরাজয় চিন সেনার মনে কাঁটার মত বিঁধবে। পার্বত্য এলাকায় ভাবতীয় সেনা পৃথিবীর সেরা যোদ্ধা, তা জানে চিন। নিজের ঘরে বিপদকে কেউ আমন্ত্রণ জানায় না – তা জানে চিন।