নয়াদিল্লি: ১৯৯৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি৷ সেই রাতের ভয়ঙ্কর স্মৃতি আজও তাড়া করে বেড়ায় পুনমকে৷ সেই নৃশংস অত্যাচার৷ শ্বশুর বাড়ির লোকজনের কটুকথা৷ আর সব শেষে চরম পরিণতি৷
আরও পড়ুন- মাঝ আকাশে অসুস্থ যাত্রীর প্রাণ বাঁচালেন মন্ত্রী, প্রশংসায় পঞ্চমুখ মোদী
পুনম রাই৷ জীবন সংগ্রামের এক জ্বলন্ত উদাহরণ৷ কন্যা সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর থেকেই শ্বশুরবাড়ির লোকের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন পুনম৷ গত দু’মাস ধরে কটূক্তি শুনেই দিন কাটছিল তাঁর৷ সেই রাতে মেয়েকে পাশের ঘরে শুইয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন তিনি৷ তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন৷ কিন্তু ফল হয়েছিল তার উল্টো৷ শ্বশুরবাড়ির লোকের বিরুদ্ধে মুখ খোলায় চরম পরিণতি হয়েছিল তাঁর৷ যা আজও এক আতঙ্কের স্মৃতি৷
১৯৯৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি৷ সেই রাতে কথা কাটাকাটির পর শ্বশুর-শাশুড়ির উস্কানিতে পুনমকে টেনে হিঁচড়ে তিন তলায় নিয়ে এসেছিলেন তাঁর স্বামী৷ তার পর তাঁকে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দেন তিনি৷ এর পর সবটাই অন্ধকার৷ দিন কয়েক পর জ্ঞান ফেরে পুনমের৷ তখন সারা শরীর অসার৷ শুধু চোখের পাতা দুটোই যা নড়ত৷ আর দু’চোখ বেয়ে গরিয়ে পড়ত জল৷ কোমায় চলে গিয়েছিলেন পুনম৷
এই ভাবে দীর্ঘ ১৫ বছর শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি৷ হাঁটা চলা তো দূর, ঠিক মতো বসতেও পারতেন না৷ পিঠের শিড়দাঁড়াটা একেবারে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল৷ চিকিৎসকরা তাঁর হাঁটাচলার আশা একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছিলেন৷ কিন্তু হাল ছাড়েননি পুনম৷ নিজের সন্তানের জন্য উঠে দাঁড়ানোর জেদ তাঁকে শক্তি জোগায়৷ আজ সেই পুনমই একজন শিক্ষিকা৷ নিজে একটি স্কুল খুলেছেন তিনি৷ সেখানে পিছিয়ে পড়া, অত্যাচারিত, নির্যাতিত মেয়েদের আত্মরক্ষার পাঠ দেন তিনি৷ দেন বেঁচে থাকার মন্ত্র৷
পুনমের লড়াইয়ের দিনগুলিতে তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তাঁর বাবা৷ কিন্তু ২০১৪ সালে বাবার মৃত্যু হয়৷ বাবার নামেই নিজের স্কুলের নাম দেন বিন্দেশ্বর রাই ফাউন্ডেশন৷ পুনমের বাবা তাঁকে জীবনের অন্য পাঠ দিয়েছিলেন৷ ভাই-বোনের মধ্যে কখনও বিভেদ করতে দেখেননি তিনি৷ বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেন্টিংয়ে স্নাতক পুনমের খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায়৷ কলেজ পাশ করতেই ‘ভালো’ পাত্র দেখে বিয়ে দেন পুনমের পাবা৷ পাত্র পিডব্লিউডি’র ইঞ্জিনিয়র!
পুনমের বাবা ভেবেছিলেন শিক্ষিত পরিবারে গিয়ে মেয়ে সুখী হবে৷ কিন্তু বিয়ের কয়েক দিন পরেই পুনম জানতে পারেন, তাঁর স্বামী আদতে স্কুলের গণ্ডিই পেরননি৷ মিথ্যে বলে ছেলের বিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ গাড়ি বোঝাই জিনিস আর মোটা টাকা পণ নিয়েছে পাত্রপক্ষ৷ সত্যিটা জানার পরেই বাড়ি ফিরে আসেন পুনম৷ কিন্তু কয়েক মাস পর জানতে পারেন তিনি অন্তঃসত্ত্বা৷ খবর পেয়ে তাঁর স্বামী এসে ক্ষমা চেয়ে পুনমকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যান৷
পুনম কন্যা সন্তানের জন্ম দিতেই বেরিয়ে পড়ে তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের আসল চেহারা৷ সেই থেকে শুরু হয় অত্যাচার৷ মানসিক অত্যাচারের পাশাপাশি চলত শারীরিক নির্যাতন৷ এক দিন প্রতিবাদ করেছিলেন পুনম৷ সেই রাতেই ঘটল চরম ঘটনা৷ পুনমের বয়স তখন মাত্র ২২৷ এর পর ১৫টা বছর তাঁর কেটে যায় বিছানায়৷ চিকিৎসা আর ফিজিওথেরাপি করতে করতে একটু একটু করে সাড় ফেরে শরীরে৷ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান পুনম৷
প্রথমে স্কুলের মেয়েদের শুধু আঁকা শেখাতেন তিনি৷ পরে একজন তাইকোন্ডা শেখানোর শিক্ষক রাখেন৷ পুনম নিজেও আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ নেন৷ তিনি নিজেও পাঠ দেন তাঁর স্কুলের মেয়েদের৷ পুনমের একমাত্র সন্তান প্রিয়া এখন বেশ বড়৷ ২৪ বছর বয়স৷ বিজনেস অ্যাডমিনিস্টেশন নিয়ে পড়াশোনা করছেন৷ পুনম শুধু তাঁর মেয়ের আইডল নন, তিন হাজার ছাত্রীর বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা৷