নয়াদিল্লি: মুঘল সম্রাট জহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবরের সেনাপতি মীর বাকি ১৫২৭ সালে অওধ দখল করার পর সরযূর তীরে সম্রাটের জন্য গড়ে তুলেছিলেন তিন গম্বুজওয়ালা এক মসজিদ৷ এটিই বাবরি মসজিদ নামে পরিচিত৷ যা পরবর্তী সময়ে ভারতীয় রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি বিতর্কের কেন্দ্র বিন্দু হয়ে ওঠে৷
বলা হয়, ওই জমি নাকি রামলালার জন্মভূমি হিসাবে বিবেচিত হত৷ কিন্তু মুঘল আমলে রাম মন্দির ভেঙে সেখানে গড়ে তোলা হয় বাবরি মসজিদ৷ পরে এই মসজিদের তলায় হিন্দু স্থাপত্যের কথা উল্লেখ করা হলেও মন্দিরের কথা উল্লেখ করেনি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ৷ ব্রিটিশ নথিতেও এই জমি নিয়ে সাম্প্রদায়িক বিতর্কের উল্লেখ রয়েছে৷ ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর এই জমিকে নাকি লোহার বেড়া দিয়ে দু’ভাগ করে দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার৷
আরও পড়ুন- বাবরির পর এবার মথুরা! শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমির আধিকার নিয়ে মামলা
১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ জমানাতেও এই জমিকে কেন্দ্র করে বিবাদ গড়িয়েছিল আদালতে৷ এখানে রাম মন্দির গড়ার আবেদন জানিয়ে ফৈজাবাদ আদালতে গিয়েছিলেন রামলালার প্রধান পুরোহিত মহন্ত রঘুবীর দাস৷ সেখানে তাঁর আবেদন খারিজ হওয়ার পর তিনি যান জেলা আদালতে৷ ১৮৮৬ সালে ফৈজাবাদের জেলা শাসক তাঁর রায়ে জানান, ‘‘হিন্দু জমির উপর মসজিদ গঠন দুর্ভাগ্যজনক হলেও, এটি ৩৫৬ বছর আগের ঘটনা৷ ফলে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা ছাড়া এখন আর কিছু করা সম্ভব নয়৷’’ এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে রঘুবীর পৌঁছন অওধের বিচারবিভাগীর কমিশনার ডব্লুই ইয়ংয়ের কাছে৷ সেখানেও তাঁকে ফিরতে হয় খালি হাতে৷ এরই মধ্যে মসজিদের মালিকানা নিয়েও শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যেও বিবাদ বাধে৷ পরে আদালতের রায়ে বলা হয়, যেহেতু সম্রাট বাবর সুন্নি ছিলেন, তাই এই মসজিদ সুন্নিদের৷ তবে মীর বাকি ছিলেন শিয়া৷
স্বাধীনতার পর বাবরি মসজিদ নিয়ে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়৷ ১৯৪৯ সালে ২২ ডিসেম্বর রাতের অন্ধকারে বাবরি মসজিদের গম্বুজের নীচে রামলালার মূর্তি স্থাপন করা হয়৷ এই ঘটনায় ৬০ জনের নামে এফআইআর দায়ের করা হয়৷ এফআইআর-এ বলা হয়, ৫০-৬০ জন গভী রাতে তালা ভেঙে এই মূর্তি স্থাপন করেছে৷
১৯৮৯ সালে ফের রাম মন্দির নির্মাণের আবেদন জানিয়ে মামলা করা হয়৷ ওই জমিতে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেয় এলাহাবাদ হাইকোর্ট৷ ওই বছরই নভেম্বর মাসে এই বিতর্কিত জমির বাইরে শিলান্যাস করে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ৷ ১৯৯০ সালে গুজরাতের সোমনাথ মন্দির থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত শুরু হয় লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথযাত্রা৷ তিনি ঘোষণা করেন, ৩০ অক্টোবর অযোধ্যা পৌঁছে করসেবার মাধ্যমে রামমন্দির নির্মাণের সূচনা করবেন৷ কিন্তু অযোধ্যা পৌঁছনোর আগেই বিহারের সমস্তিপুরে তাঁর রথ আটকান লালু প্রসাদ যাদব৷ গ্রেফতার করা হয় আডবাণীকে৷ ৩০ অক্টোবর কিছু রামভক্ত করসেবার চেষ্টা করলেও তা ভেস্তে দেয় মুলায়ম সিং যাদবের সরকার৷
আরও পড়ুন- ‘সুবিচার হয়নি’, বাবরি রায়ে ক্ষুব্ধ ওয়েইসি, সুর চড়াল কংগ্রেসও
১৯৯১ সালে উত্তর প্রদেশে ক্ষমতায় আসে বিজেপি৷ মুখ্যমন্ত্রী হন কল্যাণ সিং৷ নতুন করে শুরু হয় কর সেবার তোড়জোড়৷ ১৯৯২ সালে সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে করসেবার অনুমতি দেওয়ার আবেদন জানায় কল্যাণ সিং সরকার। মসজিদের নিরাপত্তার আশ্বাসও দেন৷ কিন্তু সরকারি আশ্বাসে কাজ হয়নি৷ ৬ ডিসেম্বর হাজার হাজার উন্মত্ত কর সেবক গুঁড়িয়ে দেয় বাবরি মসজিদ৷ ওই দিনই উত্তর প্রদেশে জারি হয় রাষ্ট্রপতি শাসন৷ রামকথাকুঞ্জের মঞ্চ থেকে প্ররোচনামূলক বক্তৃতার অভিযোগে লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলীমনোহর জোশী, অশোক সিঙ্ঘল, গিরিরাজ কিশোর, উমা ভারতী, সাধ্বী ঋতম্বরা, বিনয় কাটিয়ার এবং বিষ্ণু হরি ডালমিয়ার বিরুদ্ধে এফআই আর দায়ের করা হয়। গঠিত হয় তদন্ত কমিশন৷ সেই সঙ্গে ১৯৯৩ সালে ওই বিতর্কিত জমির দখল নেয় কেন্দ্র৷ ১৯৯৩ সালে আট নেতা সহ ৪০ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ কররে সিবিআই৷ আজ ২৮ বছর পর সেই মামলায় ক্লিনচিট পেলেন আডবাণী-জোশীরা৷