স্বচ্ছ ভারতের লজ্জাজনক চিত্র, এনসিআরবি-র রিপোর্টে প্রতিদিন দেশে আত্মঘাতী ৬৩ জন গৃহবধূ

এনসিআরবি-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৭ সালে দেশে যখানে ২১,৪৫৩ জন গৃহবধূ আত্মঘাতী হয়েছিলেন। সেখানে ২০১৮ সালে তা ৯.৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছিল ২২,৯৩৭। অর্থাৎ ৯.৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিগত কয়েক দশক ধরে দেশে নারী জাতির উন্নতিকরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ সত্ত্বেও সমস্যার শিকড় যে কতটা গভীরে তার পরিমাপ এই তৃতীয় বিশ্বের যুগেও অধরা। এটাই হয়তো তার বড় প্রমাণ যে  ভারতে আত্মহত্যার পরিসংখ্যানে একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছেন গৃহবধূরা। এমনই হতাশাজনক তথ্য উঠে এসেছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর বিশ্লেষণে। ২০১৮-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী গড়ে ১৭.১ শতাংশ হারে এইবছর প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ৬৩ জন গৃহবধূ আত্মঘাতী হয়েছেন। জাতীয় পরিসংখ্যান হিসেবে ২০০১ সাল থেকে প্রতিদিন কুড়ি হাজারেরও বেশি গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে আত্মহত্যার কারণে। যেখানে দেশে দিনমজুর হিসেবে উপার্জনকারীদের আত্মহত্যার হার সবথেকে বেশি যারা বেকারত্ব, কৃষি সংকট এবং অসংগঠিত খাতের ধীর বিকাশের কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে যা তাদের দারিদ্র্যতা ও হতাশার কারণ। সেখানে গৃহবধূদের আত্মহত্যার হার পরিসংখ্যানের নিরিখে দ্বিতীয়। ২০১৮ ল্যানসেট রিপোর্ট অনুসারে ২০১৬ সালে বিশ্বে নারীদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি (৩৬.৬%) আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ভারতে। যা ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ ২৫.৩ শতাংশের ওপরে। এরমধ্যে বিবাহিত নারীদের সংখ্যাই বেশি ছিল। ভারতের গৃহবধূদের আত্মহত্যার কারণগুলির মধ্যে রয়েছে যেমন, অল্পবয়সী মেয়েদের বিয়ে, অল্পবয়সে মা হওয়া, অনুন্নত সামাজিক প্রেক্ষাপট, পারিবারিক অশান্তি, অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা প্রভৃতি।

লেখিকা তথা সমাজ বিজ্ঞানী দীপা নারায়ণের মতে, মেয়েরা নিজেরাই বিয়ের ব্যাপারে বেশি আগ্রহ দেখায়। কিন্তু পরবর্তীকালে বিয়ের পর বাস্তবটা বুঝতে পারে এবং নিজের অপমানজনক বন্দীদশা মেনে নিতে পারেনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনা। যদিওবা কেউ সেই চেষ্টা করে, তারা আবার প্রয়োজনীয় সাহায্য পায়না। তেমন শশুর বাড়িতে মেয়েরা লাঞ্ছিত হলে বেশিরভাগ মেয়েদের অভিভাবকরা সেখানে মানিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ শশুরবাড়ির অমানবিক মনোভাবকে প্রশ্রয় দিয়ে মেয়েকে সেখানে একঘরে করে দেওয়া হয় বলেও উল্লেখ করেছেন দীপা নারায়ণ। সেক্ষেত্রে মেয়েরা বিবাহবিচ্ছেদ চাইলে তাদের সমর্থন করে পাশে দাঁড়াতে চায় না তার নিজের পরিবার। আর এই কারণেই আত্মহত্যা ছাড়া সেই গৃহবধূদের কাছে আর কোনো উপায় থাকেনা বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

 

এনসিআরবি-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৭ সালে দেশে যখানে ২১,৪৫৩ জন গৃহবধূ আত্মঘাতী হয়েছিলেন। সেখানে ২০১৮ সালে তা ৯.৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছিল ২২,৯৩৭। অর্থাৎ ৯.৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। যা প্রমান করে যে আত্মহত্যা সংখ্যা বা পুলিশের কাছে এই সংক্রান্ত রিপোর্ট বেড়েছে। বিবাহিত মেয়েদের আত্মহত্যার ঘটনা অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশের কাছে জানাতে চায়না তাদের পরিবার। তার ফলে জাতীয় অপরাধমূলক পরিসংখ্যানের অবমূল্যায়ন হয়। এটা কোন পরিবারের পক্ষে অত্যন্ত খারাপ দিক যেখানে তাদের প্রিয় জন হতাশা বা আরো কোনখারাপ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, বলছেন সমাজ বিজ্ঞানী‌ দীপা নারায়ণ।

অনেক সময় দেখা গেছে গৃহবধূদের আত্মঘাতী হওয়ার ক্ষেত্রে, অন্য সমস্ত কারণের মধ্যে অর্ধেক কারণ হয়  পণপ্রথা। এই ধরনের ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণত কোন অভিযোগ দায়ের হয় না, যেহেতু মেয়েদের বাড়ি থেকে পণ দেওয়া হয়, যা আইনত অপরাধ। পণ দেওয়া নিয়ে গৃহবধূদের আত্মহত্যার ঘটনাগুলিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনা বা আগুন লেগে মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ দায়ের করা হয়। যেমন, বাথরুমে পড়ে গেছে, স্টোভ ফেটে গিয়ে আগুন লেগেছে এই ধরনের দুর্ঘটনা বলে উল্লেখ করা হয় বলছেন দীপা। ২০১৬ সালে গৃহবধূদের আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে এমনটাই দেখা গেছে। মুম্বাইয়ের সেন্টার ফর ইনকোয়ারি ইনটু হেলথ অ্যান্ড অ্যলায়েড থিমস এবং টাকা ইনস্টিটিউট অফ সোশাল সায়েন্স যৌথভাবে এই সমীক্ষা চালিয়েছিল। তাদের তথ্য অনুসারে প্রতি ২২ জন গৃহবধূর অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় ১৫ জনই আত্মঘাতী। এরমধ্যে মাত্র তিনটি দুর্ঘটনাজনিত। বাকি ঘটনাগুলি নিজের বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের অসাবধানতা কারনে ঘটেছে। এই তথ্যে আরও উঠে এসেছে যে, অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর ওই ২২ টি ঘটনার মধ্যে ১৯ টি পারিবারিক অশান্তির কারণে। 

২০১৫-১৬ সাল থেকে করা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সের ২০২০-র জানুয়ারিতে প্রকাশিত গবেষণামূলক তথ্যের ভিত্তিতে  আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যার চেষ্টা সবমিলিয়ে আত্মঘাতী হওয়ার মনোভাব ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যেই বেশি। মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি এতটাই কলঙ্কজনক যে মহিলারা এ বিষয়ে কথা বলতেও দ্বিধা বোধ করেন, বলেছেন দীপা নারায়ণ।

তবে এই পরিস্থিতিতে পারিবারিক সহিংসতার শিকার মহিলাদের বাড়িতে গিয়ে তাদের কাউন্সেলিংয়ের প্রস্তাব দেয় এবং প্রয়োজনে আইনি সহায়তার জন্য তাদের সরাসরি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে তাদের সাহায্য করে জাতীয় মহিলা কমিশন (এনসিডাব্লু)। তবে বেশিরভাগ মহিলাই সাহায্যের জন্য উপলব্ধ উপায়গুলি নিয়ে কথা বলেন না সেই উপায়গুলি অবলম্বন করেন না বলেই জানিয়েছেন এনসিডাব্লুয়ের মিডিয়া পরামর্শক নাং তানভী মানপং। তিনি আরও বলেন, এক্ষেত্রে সমাজ নারীদের সঙ্গে কিভাবে আচরণ করে এবং আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে আরও বেশি উদ্যোগ অর্জন করা দরকার, এই সমস্ত বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এনসিডাব্লু তাদের সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালিয়ে, যাচ্ছে। 

সমাজে পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব পরিবর্তন করার জন্য, কেবল সচেতনতা নয়, সমাজিক উপলব্ধি পরিবর্তনেরও ক্ষেত্রেও গুরুত্ব দিতে হবে। দ্য মাইন্ড রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বকীর্তি ভান ছাব্রাও একমত। তিনি বলেন, পরিবারে মেয়েদের  শিক্ষিত করে তোলা ও যথাযোগ্য সম্মান দেওয়া দরকার। ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এই ধারণা তৈরি করা উচিত নয় যে ছেলেরা বাড়ির বাইরে কাজ করার জন্য জন্মগ্রহণ করেছে এবং মেয়েরা ঘরের কাজ করতে বাধ্য।

সমাজবিজ্ঞানী দীপা নারায়ণের স্পষ্ট বক্তব্য, স্বচ্ছ ভারত অভিযানে আমরা দেশ পরিষ্কার করছি কিন্তু নিজেদের মন পরিষ্কার করছি কি? পুরুষদের বুঝতে হবে যে মহিলারা তাদের সম্পত্তি নয়, তাদের নিজেদেরও একটা জীবন আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × 1 =