নয়াদিল্লি: ১৪ এপ্রিল জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দাবি করেছেন যে ভারতে একটিও করোনা সংক্রামণের ঘটনা ঘটার আগে থেকেই দেশের আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরগুলিতে করোনা সংক্রামিত দেশ থেকে ফেরা যাত্রীদের স্ক্রিনিং শুরু হয়েছিল। কিন্তু বাস্তব বলছে অন্য কথা। এই সংক্রান্ত তথ্যের ভিত্তিতে করা একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৮ জানুয়ারি, ২০২০ থেকে কেবল চীন এবং হংকংয় ফেরত যাত্রীদের স্ক্রিনিং শুরু হয়েছিল দেশের মাত্র তিনটি বিমানবন্দর দিল্লি, মুম্বই ও কলকাতায়। এরপর ২১ জানুয়ারি, ২০২০ তে আরও চারটি এবং তারপর ২৮ জানুয়ারি, ২০২০ থেকে আরও ১৩ টি বিমানবন্দরে স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। 'স্ক্রল' সংবাদ মাধ্যমের 'ফ্যাক্ট চেক' বিভাগের প্রতিবেদনে এমনটাই উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুসারে ৩ জানুয়ারি, ২০২০ সালে যখন ভারতে প্রথম করোনা সংক্রমণের হদিশ মেলে সেদিনই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ কে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা হিসাবে ঘোষণা করেছিল। হু বলেছিল – ভারতের বিমানবন্দরগুলি কেবল চীন এবং হংকং ছাড়া অন্য কোনো দেশ থেকে আসা যাত্রীদের স্ক্রিনিং করছে না, যখন সেইসময়ের মধ্যে ২০টি দেশে করোনা সংক্রামণের ঘটনা ঘটেছে।
থাইল্যান্ড (১৪), সিঙ্গাপুর (১০), অস্ট্রেলিয়া (৫), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (৫), জাপান (৮), দক্ষিণ কোরিয়া (৪), মালয়েশিয়া (৭), ফ্রান্স (৪), ভিয়েতনাম (২), কানাডা (২), নেপাল (১), কম্বোডিয়া (১), শ্রীলঙ্কা (১), জার্মানি (৪), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৪), হংকং (১০), মাকাও (৭), তাইওয়ান (৮), ফিনল্যান্ড (১) এবং অ্যাঙ্গোলা (১)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানুয়ারী ২৩, ২০২০ এ তার প্রথম মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে, এবং ইতালি এবং স্পেন তাদের প্রথম মামলা যথাক্রমে জানুয়ারী ৩১, ২০২০ এবং ফেব্রুয়ারী ১, ২০২০-এ করেছে।
প্রথম থেকে ভারতের যে ২৭ জন করোনা পজিটিভ ছিল তাদের মধ্যে প্রথম তিনজনের সংক্রামণ ধরা পড়ে ২০২০ সালের ৩০ শে জানুয়ারী, ২ ফেব্রুয়ারি এবং ৩ ফেব্রুয়ারি তাদের প্রত্যেকের চীন ভ্রমণের ইতিহাস ছিল। চতুর্থ এবং পঞ্চম রোগীর (২২ শে মার্চ, ২০২০ সনাক্ত হওয়া) যথাক্রমে ইতালি এবং দুবাই ভ্রমণের ইতিহাস ছিল। ২০২০ সালের ৪ মার্চ, ভারত নতুন করে যে ২২ টি করোনা সংক্রামণ সনাক্ত করা হয় – সেই রোগীদের মধ্যে ১৪ জন জয়পুরে ইতালি থেকে আসা পর্যটক ছিলেন।
সরকার সমস্ত আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের প্রত্যেক যাত্রীর স্ক্রিনিং বাধ্যতামূলক করেছিল ৪ মার্চ, ২০২০ থেকে, যখন ইতিমধ্যেই দেশের ৫ টি রাজ্য মিলিয়ে মোট ২৭ জন করোনা আক্রান্ত।
এর আগে, ২০২০ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারি একটি পরামর্শ মেনে সিঙ্গাপুরে অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি কাঠমান্ডু, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম এবং মালয়েশিয়া থেকে ভারতে আসা ফ্লাইটগুলিতে বিক্ষিপ্তভাবে স্ক্রিনিংয়ের পরিমাণ বাড়িয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ তে ইরান, ইতালি এবং কোরিয়ার প্রজাতন্ত্রে ভ্রমণ এড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে। এরপর ৩ মার্চ, ২০২০ তে প্রথমবার ইতালি, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এবং চীনের ভিসা স্থগিতের আহ্বান জানিয়েছিল।
এরপর, “চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ইরান, ইতালি, হংকং, ম্যাকাও, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এবং তাইওয়ান থেকে ভায়া বা সরাসরি আসা ভারতীয় এবং বিদেশী উভয় যাত্রীদের (যাদের ওপর বিধিনিষেধ নেই) জন্য বিমান বন্দরে প্রবেশের সময় প্রবেশ দ্বারেই মেডিকেল স্ক্রিনিং বাধ্যতামূলক করা হয় ”, ৩ মার্চ,২০২০ থেকে। ১৪ এপ্রিল,২০২০-তে ফার্স্টপোস্ট একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল র, ১১এপ্রিল,২০২০ তে মহারাষ্ট্রে লকডাউনের বর্ধ্বিত সময়সীমা ঘোষণার দিন মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে বলেছিলেন,” আমরা তখন বিমানবন্দরে যাত্রীদের স্ক্রিনিং শুরু করি, তখন কেন্দ্রের দেওয়া দেশগুলির তালিকা অনুসারেই যাত্রীদের পরীক্ষা করেছিলাম। তবে কয়েকটি দেশকে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, ফলে সেখানকার কিছু যাত্রীরা ছাড় পেয়ে যায়, ” এই তালিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, যেখানে তখনই করোনা সংক্রামণের ঘটনা ঘটেছে।
২৪ মার্চ,২০২০-তে নিউজ মিনিটের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌদি আরব, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো উপসাগরীয় দেশগুলি থেকে এই কোভিড-১৯-এর ঘটনা ধরা পড়েছিল “সরকারের আগে থেকে এবিষয়ে ধারণা না থাকায়, এমন একটি সমস্যা তৈরি হয়,” ২৩ মার্চ, ২০২০ পর্যন্ত কেরালায় ৯৫ জনের করোনা পজিটিভ সনাক্ত করা হয়, যারা মূলত সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার এবং সৌদি আরবের মতো দেশগুলি থেকে ফিরেছিলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “কেরালা তার উপসাগরীয় প্রত্যাবাসীদের অনেকের পরীক্ষা করার পরে এটি আবিষ্কার করেছে, তবে অন্যান্য অনেক রাজ্যে, যারা ইতালি, কোরিয়া এবং স্পেন থেকে কয়েকটি দেশের নাম প্রত্যাবর্তন করেছে তাদের প্রতি দৃly়ভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছে,” রিপোর্টে বলা হয়েছে। এছাড়াও ইতালি, ব্রিটেন ও স্পেন থেকে ফেরা ভারতীয়দের মধ্যেও করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে।
প্রসঙ্গত, ২৩ মার্চ থেকে পশ্চিমবঙ্গে লকডাউন ঘোষণা হলেও বিমান চলাচলের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি কেন্দ্র। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবিষয়ে জরুরী ভিত্তিতে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে। সেখানে বলা হয়েছিল ‘‘ভারত সরকার এখনও বিমান চলাচল চালু রাখায় আমরা গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন। এর ফলে শাটডাউন ও কোয়ারান্টাইনের প্রোটোকলের লঙ্ঘন হচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোনও ব্যবস্থা না থাকায় আমরা বিষয়টি নিয়ে রাজ্যে বেশ কষ্টকর পরিস্থিতিতে পড়েছি।'' তিনি আরও লেখেন, ‘‘আমি আপনাকে অনুরোধ করছি দয়া করে প্রয়োজনীয় নির্দেশের মাধ্যমে রাজ্যে সমস্ত বিমানের অবতরণ বন্ধ করুন অবিলম্বে। যাতে সংক্রমণ ছড়ানো বন্ধ করা সম্ভব হয় এবং রাজ্যে প্রকৃত অর্থে লকডাউন করা যায়।''