নয়াদিল্লি: উদ্দেশ্য সচন৷ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান৷ বাবা ছিলেন সামান্য দর্জি৷ অভাবের সংসারে নুন আনতে ফুরোত পান্তা৷ মাসের শেষে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে যে টুকু টাকা পড়ে থাকত, তা দিয়ে সন্তানের স্কুলের ফি ভরা দুষ্কর হয়ে উঠেছিল তাঁর কাছে৷ উদ্দেশ্য তখন ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ুয়া৷ ফি দিতে না পারায় স্কুল ছাড়তে হল তাঁকে৷ এই ঘটনাটা ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়ে গিয়েছিল কানপুরের বাসিন্দা উদ্দেশ্যর জীবনকে৷ এক সময়ের স্কুল ছুট উদ্দেশ্যই আজ গুরুকুলমের প্রতিষ্ঠাতা৷
আরও পড়ুন- ৪০০ ফুট গভীর গর্তের ৫৫ ফুটে আটকে ছিল তন্ময়! ৬৫ ঘণ্টা পর বেরিয়ে এল নিথর দেহ
বছর ৩১-এর সচন এক জাতীয় স্তরের সাংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘এই ঘটনাটি আমাকে বদলে দিয়েছিল। আমাকে পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হয়েছিল৷ সেই ঘটনাটা আমি কখনওই ভুলতে পারিনি।” ২০১৯ সালে তিনি শুরু করেন ‘গুরুকুলম- খুশিয়োঁ ওয়ালা স্কুল (খুশির স্কুল)৷ নামের সঙ্গে সত্যিই মিল রয়েছে এর৷ কারণ এই স্কুলে শিশুরা নেয় জীবনের পাঠ৷
ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুল ছাড়ার ধাক্কাটা উদ্দেশ্যকে ভিতর থেকে ভেঙে দিয়েছিল৷ তবে কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য ছন্দে ফেরে তাঁর জীবন৷ বাবার ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি ঘটে৷ নতুন করে অন্য স্কুলে ভর্তি করা হয় তাঁকে৷ এর পর আর থামতে হয়নি৷ দর্শন নিয়ে স্নাতক পাশ করেন উদ্দেশ্য৷ ছেলের এই সাফল্যে বেশ আনন্দিতই ছিল তাঁর মধ্যবিত্ত পরিবার৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার পরিবার চেয়েছিল আমি যেন একটি ভাল বেতনের চাকরি পেয়ে জীবনে থিতু হতে পারি৷ কিন্তু আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম না। আমি কখনই মনে করিনি যে আমার কাজ করার দক্ষতা আছে৷ আমি প্রতিযোগিতার ভিড়ে যোগ দিতে চাইনি৷ যেখানে মানুষ তাঁর সারাটা জীবন কোনও না কোনও কিছুর পিছনে দৌড়তে থাকে৷ আমার কাছে পৃথিবীটা খুবই অসুখী জায়গা৷’’ তাঁর কথায়, ‘‘শিশুদের সব সময় শেখানো হয়, কী ভাবে সফল হতে হয়৷ আমি তাঁদের শেখাতে চেয়েছি কী ভাবে জীবনটাকে উপভোগ করতে হয়৷ সেই ধারণা থেকেই জন্ম নেয় ‘গুরুকুলম’৷
২০১৯ সালে বস্তির পাঁচজন শিশুকে নিয়ে শুরু হয় উদ্দেশ্যর খুশির স্কুল৷ ভাড়া বাড়ির ফাঁকা ক্লাস ঘরে একটা হোয়াইটবোর্ড নিয়ে তিনি বাচ্চাদের পড়াতে শুরু করেন। আজ সেই সংখ্যাটাই বেড়ে ১৫০৷ স্কুলে আসতে দারুণ পছন্দ করে খুদেরা৷ এক নজরে স্কুলটি আর পাঁচটা সাধারণ স্কুলের মতো লাগলেও, এর ভিতরে উঁকি দিলে জানা যায় প্রকৃত কাহিনি৷ এখানে ছোটদের বিভিন্ন রকম বইয়ের সঙ্গে পরিচয় গড়ে তোলা হয়৷ বড় পড়ুয়ারা ছোটদের সঙ্গে শেয়ার করেন তাদের অভিজ্ঞতা৷ তিনজন শিক্ষক এবং বেশ কিছু বয়সে বড় পড়ুয়া গুরুকুলামের ক্লাস শেষ করার পর বিজ্ঞান, গণিত এবং সঙ্গীতের মতো বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের অন্তর্দৃষ্টি ভাগ করে নেন৷
ভোর পাঁচটায় যোগা দিয়ে শুরু হয় গুরুকুলমের ক্লাস৷ তাতে যোগ দেন উঁচু ক্লাসের পড়ুয়ারা৷ এর পর এক ঘণ্টা ধ্যান সেরে তারা ফিরে যায় নিজের নিজের বাড়িতে৷ সকাল ৮টায় ফের স্কুল শুরু৷ সেই সময় স্কুলে আসে ছোটরাও৷ উদ্দেশ্য জানান, এখানে পড়ুয়াদের বয়স অনুযায়ী সিলেবাস তৈরি করা হয়৷ তাদের সিনেমা, থিয়েটার, সংবাদ, বিজ্ঞান ভিত্তিক ভিডিয়ো, তথ্যচিত্র ইত্যাদির মাধ্যমে শেখানো হয়। এখানে বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোচনা করা হয়৷ সবটাই হয় ঘরোয়া পরিবেশে৷ দুপুর দুটোয় পড়ুয়ারা বাড়ি ফিরে যায়৷ ৪টে বাজলে ফের স্কুলে ফিরে আসে তারা৷ বিকেল পাঁচটায় স্কুল ছুটি হয়৷ স্কুলে আছে হারমোনিয়াম, তবলা সহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র৷ এখানে সঙ্গীতের পাঠও নেন তাঁরা৷
উদ্দেশ্য জানান, তাঁর স্কুল চলে অনুদানে৷ পড়ুয়াদের থেকে একটা টাকাও নেওয়া হয় না৷ তবে সব সময় সকলে অনুদান দিতে চান না৷ তবে তিনিও হার মানতে নারাজ৷ অনাথ গরিব ছেলে-মেয়েদের জীবন গড়াই তাঁর লক্ষ্য৷ তিনিই ওদের স্বপ্ন তৈরির কারিগড়৷
” style=”border: 0px; overflow: hidden”” title=”YouTube video player” width=”560″>