নয়াদিল্লি: ভারতে ব্রিটেনের ঔপনিবেশিকতা নিয়ে একটি মিথ চালু রয়েছে সে মুলুকে৷ বলা যায় একটা ভুল ধারনায় আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে ব্রিটেনের মানুষকে৷ কথিত রয়েছে, ভারতবর্ষে ব্রটিশ সাম্রাজ্য নাকি একেবারেই লাভদায়ক ছিল না৷ উল্টে প্রশাসনিক কাজে প্রভূত অর্থ ব্যয় করতে হয়েছিল তাদের৷ এর পরেও ব্রিটিশরা যে ভারতবর্ষের মাটি কামড়ে পড়েছিল, এটা তাঁদের বদান্যতা৷ ভারতে ব্রিটিশরা সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলে আখিরে লাভ হয়েছিল ভারতেরই৷ অনেক বেশি উন্নত হয়েছিল উপমহাদেশ৷
আরও পড়ুন- নতুন দায়িত্ব পাচ্ছেন বিপ্লব, ধন্যবাদ জানালেন মোদী-শাহকে
তবে ব্রিটিশদের এই বদ্ধমূল ধারণায় সজোরে কুঠারাঘাত করেছে সাম্প্রতিক এক গবেষণা৷ কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ উৎসা পট্টনায়েকের গবেষণায় উঠে এসেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চিত্র। ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের প্রায় দুই শতকের কর ও বাণিজ্যের খতিয়ান তুলে ধরে পট্টনায়েক যে হিসাব দেখিয়েছেন তাতে, ১৭৬৫ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে ভারত থেকে ৪৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সম্পদ নিজেদের দেশে নিয়ে গিয়েছে ব্রিটিশরা।
পট্টনায়েকের গবেষণায় উঠে আসা এই তথ্য নিশ্চিতভাবেই বিস্ময়কর৷ কারণ সংখ্যাটা সুবিশাল৷ এই বিশালত্বের ব্যাখ্যা দিতে একটি ছোট্ট তথ্য তুলে ধরা যাক- ভারত থেকে লুট করা এই ৪৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আজকের দিনেও ব্রিটেনের জিডিপি (গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট)-র চেয়ে ১৭ গুণ বেশি! কিন্তু কী ভাবে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্রিটেনে পৌঁছল? সেই তথ্যও তুলে ধরেছেন পট্টনায়েক৷
তিনি জানাচ্ছেন, এটি মূলত সংঘটিত হয়েছিল বাণিজ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে৷ ভারতে উপনিবেশ গড়ার আগে ব্রিটেন ভারতীয় উৎপাদকদের কাছ থেকে বস্ত্র এবং চালের মতো পণ্য আমদানি করত৷ এবং লেনদেন চলত রুপোয়৷ আমদানীকৃত পণ্যের বিনিময়ে তাঁরা উৎপাদকদের সিলভার দিত৷ অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও একইভাবে রৌপ মুদ্রা দিয়ে অর্থ পরিশোধ করতে ব্রিটিশরা। তবে ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উপমহাদেশের নিয়ন্ত্রণ কুক্ষিগত করার পর এই ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসে৷ ভারতীয় বাণিজ্যের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নেয় কোম্পানি৷ উপমহাদেশে শুরু হয় মনোপলি৷ যার ভিত্তি ছিল কর৷
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারত থেকে যে কর আদায় করত, খুব চতুরতার সঙ্গে তার এক তৃতীয়াংশ ব্যবহার করত নিজেদের প্রয়োজনে৷ ওই অর্থ দিয়ে ভারতবর্ষ থেকে পণ্য ক্রয় করত তারা৷ সহজ কথায়, ভারতীয় পণ্য কেনার জন্য নিজেদের পকেট থেকে কানাকড়িও খরচ করত না ব্রিটিশরা৷ কোনও অর্থ ব্যয় না করেই চতুরতার সঙ্গে প্রয়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহ করত। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, ব্রটিশরা কৃষক ও তাঁতিদের কাছ থেকে দাম দিয়েই পণ্য কিনছেন৷ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তেমনটা হত না৷ বরং কৃষক এবং তাঁতিদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থের ব্যবহার করেই তাদের পণ্য ‘ক্রয়’ করা হত৷
এটা ছিল একপ্রকার জালিয়াতি৷ কিন্তু দুঃখজনক ভাবে অধিকাংশ ভারতীয়ই ব্রিটিশদের এই চতুরতা ধরতে পারেনি। কারণ কোম্পানির যে সকল প্রতিনিধিরা কর সংগ্রহ করতে আসতেন, তাঁরা কিন্তু পণ্য ক্রয় করতে আসতেন না। সাদামাটা ভারতীয়দের পক্ষে এই কৌশল বোঝা কোনও ভাবেই সম্ভব হয়নি৷ তাঁরা বুঝতে পারেনি যে গ্রহীতা ও দাতা আলাদা আলাদা ব্যক্তি হলেও, তাদের মূল উৎস আসলে অভিন্ন৷
ভারতবর্ষ কোথায় কোথায় পণ্য নিয়ে যাওয়া হত?
অনেকের মনেই প্রশ্ন রয়েছে, ছলনা করে ভারতবর্ষ থেকে যে পণ্য ব্রিটিশরা নিয়ে যেত, সেই পণ্য কি তারা নিজেরাই ভোগ করত? নাকি, অতিরিক্ত লাভের আশায় পরবর্তীতে তা আরও চড়া মূল্যে ইউরোপের বিভিন্ন বাজারে রফতানি করত? কারণ, সেই সময় ভারতবর্ষে উৎপাদিত পণ্যের সুনাম ছিল গোটা ইউরোপে। এবং সেগুলো আর অন্য কোনও দেশের ব্যবসায়ীদের কাছে পাওয়া যেত না৷ ফলে এই পণ্য বেচে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা শতভাগ লাভ করতে পারত। সরাসরি উৎপাদক না হয়েও ভারতবর্ষ থেকে সংগৃহীত পণ্যকে হাতিয়ার করেই ইউরোপের বাজারের অন্যতম বড় খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছিল।
ভারতবর্ষ থেকে লুঠ করা যেসকল পণ্য ব্রিটিশরা নিজেরাই ভোগ করত, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল লোহা, টার ও টিম্বার৷ এগুলো ব্রিটিশরা তাদের শিল্পায়নের কাজে লাগাত। দখতে গেলে, ব্রিটেনের শিল্পবিপ্লবও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল ছিল ভারতবর্ষ থেকে করা চৌর্যবৃত্তির উপর।
১৮৪৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের পর ব্রিটিশ সরকার সরাসরি ভারতবর্ষের ক্ষমতা নিজেদের হাতে নেয়। এতে অবশ্য ঔপনিবেশিকদের লাভের গুড় বিন্দুমাত্রও হ্রাস পায়নি৷ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মনোপলিতে ইতি পড়ার পর ভারতীয় উৎপাদকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি অন্যান্য দেশে রফতানী করার সুযোগ পেয়েছিল বটে। কিন্তু ব্রিটেন এমন কারসাজি করে যাতে সব হাত ঘুরে প্রদেয় অর্থ শেষ পর্যন্ত লন্ডনে এসেই জমা হয়৷
ভারতবর্ষ থেকে কোনও দেশ পণ্য ক্রয় করতে চাইলে তাদেরকে সেই পণ্য কিনতে হতো বিশেষ ধরনের কাউন্সিল বিলের মাধ্যমে। এখন প্রশ্ন হল এই কাউন্সিল বিল কী? এই কাউন্সিল বিল হল এমন একধরনের কাগজের মুদ্রা, যা কেবল ব্রিটেন থেকেই প্রদান করা হতো। এবং এই কাউন্সিল বিল হাতে পেতে হলে সরাসরি লন্ডনে গিয়ে সোনা বা রুপোর বদলে তা ক্রয় করতে হত। বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীরা লন্ডনকে সোনা বা রুপো দিয়ে এই বিল সংগ্রহ করত, আর তারপর সেই বিলের মাধ্যমে ভারতীয় উৎপাদকদের দাম মেটাত। ভারতীয় উৎপাদকরা যখন স্থানীয় কলোনিয়াল অফিসে গিয়ে সেই বিল ভাঙত, তখন তাদের হাতে যে ভারতীয় মুদ্রা আসত, তা ব্রিটশরা করের মাধ্যমে ভারতীয়দের কাছ থেকেই আদায় করে রাখত৷
১৭৬৫ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষকে চারটি পৃথক অর্থনৈতিক সময়কালে ভাগ করেছেন পট্টনায়ক৷ প্রতিটির মধ্য পর্যায় হতে বর্তমান পর্যন্ত ন্যূনতম ৫ শতাংশ মুনাফার হার ধরে হিসাব করে দেখান যে, ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটেনে পাচার হওয়া সম্পদের মোট পরিমাণ ছিল ৪৪.৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটেনে পাচার হওয়া এই বিপুল অর্থের ফলে এ দেশের ঠিক কতখানি ক্ষতি হয়েছে, তা কেবল তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে হিসাব করে বের করা সম্ভব নয়। ভারতের নাগরিকদের প্রদত্ত কর যদি ভারতের কল্যাণেই ব্যয় হতো তাহলে আজ ভারতবর্ষ বিশ্বের অর্থনৈতিক সুপারপাওয়ারগুলোর মধ্যে একটি হতো৷ শতকের পর শতক ধরে এ অঞ্চলের মানুষকে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হতো না।
” style=”border: 0px; overflow: hidden”” title=”YouTube video player” width=”560″>