কলকাতা: বঞ্চনা আছে৷ সমস্যাও আছে যথেষ্ট৷ স্কুলের পরিকাঠামো উন্নয়ন থেকে শুরু করে শিক্ষকদের শিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়েও রয়েছে বিতর্ক৷ আর এই বিতর্কের মাঝে শিক্ষক দিবসের বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে শিক্ষা দপ্তরের ‘শিক্ষারত্ন’ সম্মান প্রদান অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে ফের কল্পতরু মুখ্যমন্ত্রী৷
শিক্ষক দিবসের মঞ্চ থেকে রাজ্য সরকারের কোষাগার প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা, ‘‘টাকার দেখুন, আমাদের সংসার গরীবের সংসার৷ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ঋণ কখনও শোধ করা যায় না৷ মা-বাবার ঋণ শোধ করা যায় না৷ দুর্দিনের বন্ধুদের ঋণ শোধ করা যায় না৷ মা-মাটি-মানুষের ঋণ শোধ করা যায় না৷ তেমনি মনে রাখবেন আপনাদের ঋণ কখনও টাকা দিয়ে শোধ করা যাবে না৷ আমরা অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও কাজ করছি৷ গত আট বছর ধরে কাজ করতে গিয়ে আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা৷ এই বছরই আমাদের ৫৫ হাজার কোটি টাকা দেনা শোধ করতে হবে৷ একটা সরকারের ইনকাম কত? ইনকামের থেকে বেশি যদি দেনা শোধ করতে চলে যায়৷ তাহলে সেই সরকারটা কোথা থেকে কন্যাশ্রী করবে? কোথা থেকে বিনা পয়সায় সাইকেল দেবে? কোথা থেকে দু’টাকা কিলো দরে চাল দেবে? কোথা থেকে ঘরে আলো দেবে? কোথা থেকে স্বাস্থ্যসাথী দেবে? কীভাবে এত উন্নয়ন হবে? তা সত্ত্বেও আমি গর্ব করে বলতে পারি, এই ৮ বছরের যে কাজ আমরা করে দেখিয়েছি, ৮০ বছরের কেউ যদি করে দেখাতে পারে আমি চ্যালেঞ্জ করে গেলাম৷ করতে পেরেছি তার কারণ আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেছি৷’’
এরপরই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমরা যেখান থেকেই হোক টাকার ব্যবস্থা করছি৷ মায়ের কাছে সংসারে যখন পয়সা থাকে না৷ হাঁড়ির টান ধরে, মা তখন লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ভাঙে ওই সংসারটা কীভাবে সমস্যা মেটাবেন৷ সুতরাং আমরা ওরকম করি৷ এখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে সেখানে করে করে করে কোনও রকম ব্যবস্থা করি৷’’ মুখ্যমন্ত্রীর আরও মন্তব্য, ‘‘আমি সাশ্রয় করতে পারি৷ চেষ্টা করি৷ যেখানে পারি আমি করে দিই৷ এটা কখনও ভুল বুঝবেন না৷ আমাদের আছে, তাও দিচ্ছি না, তা নয়৷ একটু বাঁচলে ভাবি, আমরা কাকে ভাগ করে দেব৷ কিন্তু, টাকা থাকলে তবে তো দেব৷’’
মদের দোকান খুলে টাকা আয়ের বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা, ‘‘একমাত্র তামিলনাড়ু দেখবেন, এক্সাইজ ডিউটি থেকেই তাদের যা ইনকাম আমাদের সারাবছর সেই ইনকাম হয় না৷ কিন্তু তামিলনাড়ু যেটা করতে পারে আমরা সেটা করতে পারি না৷ আমি যদি বলি পাড়ায় পাড়ায় মদের দোকান খুলে টাকা তুলব৷ এটা আমাকে সমাজ ক্ষমা করবে না৷ এটা আমার সমাজের লোকেরা মেনে নেবে না৷ আমি হয়তো টাকা তুলতে পারি৷ কিন্তু সেটা আমি করতে পারি না৷ একটা জায়গার ওপর নির্ভর করে৷’’
কেন্দ্রকে বিঁধে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘সব জায়গায় জলের উপর কর নেওয়া হয়৷ আমরা কিন্তু বলি জলের নাম জীবন৷ আমরা জলের উপর কর নিয় না৷ সব জায়গায় পয়সা স্বাস্থ্য পরিষেবা নিতে হয়৷ কিন্তু আমাদের আমরা এখানে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে পয়সা নেই না৷ বিনা পয়সায় ওষুধ মানুষ পাচ্ছে৷ কিন্তু এই টাকাটা তো কাউকে না কাউকে দিতে হবে৷ ওই ওষুধগুলি তো কিনতে হচ্ছে৷ ওই টাকাটা পাবলিকের বদলে সরকার দিচ্ছে৷ দু’টাকা কেজি দরে চারে ২৭ টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে৷ এভাবে টাকা বেরিয়ে যায়৷ সরকার সাধারণ মানুষের টাকায় চলে৷ সরকারের নিজস্বতায় এটাই৷ কেন্দ্র সরকারের সুবিধা আছে৷ ওদের হাতে একটা রিজার্ভ ব্যাংক আছে৷ যখন প্রয়োজন টাকা তুলে নিচ্ছে৷ নোট প্রিন্ট করছে৷ আবার নোট বাতিল করে দিচ্ছে৷ তো সেই সুযোগ নেই আমাদের৷ কেন্দ্র সরকারের ক্ষমতা আছে৷ সেই তুলনায় আমাদের কিছুই নেই৷ রাজ্য সরকারের থেকে কেন্দ্র সরকার এখনও থেকে প্রচুর টাকা তুলে নিয়ে যায়৷ কিন্তু আপনারা এই নিয়ে খুব মাঝেমধ্যেই রাগ করেন৷ তখন আমার বলতে ইচ্ছা হয়, এই কথাগুলি বলে দিই৷ আমার তো দিতে কোনও আপত্তি নেই৷ কিন্তু দেব কোথা থেকে৷ ইনকাম ট্যাক্স তুলে নিয়ে যায়৷ কাস্টমার ডিউটি শুরু করে সমস্ত কর কেন্দ্র সরকার তুলে নিয়ে যায়৷ রাজ্য থেকে ৪০ হাজার টাকা রাজ্য থেকেই কেন্দ্র তুলে নিয়ে যায় কেন্দ্র৷ কিন্তু রাজ্য সরকারকে বিভিন্ন স্ক্রিমে তার জন্য ৮ থেকে ৯ হাজার কোটি টাকা দেয়৷ সেই টাকাটা এখন ঠিকমতো দিচ্ছে না৷ তবুও যতটা পারি ততটা সাধ্যমত চেষ্টা করছি৷’’
শিক্ষকদের সমস্যা মেটাতে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘সমস্যা আছে৷ সেই সমস্যার মধ্যেও আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি৷ আমি শিক্ষকদের বলব, বিশ্বাস আর ভরসা আমাদের উপরে রাখবেন৷ যখন যতটুকু পারবো, আমার সীমাবদ্ধতা আছে ফান্ডের৷ আমার সীমাবদ্ধ তহবিলের মধ্যেই যখন সুবিধা হবে আমি ব্যবস্থা করব৷’’ এদিন শিক্ষা দপ্তরকে বার্তা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী শিক্ষকদের পাশে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, ‘‘আমি শিক্ষা দপ্তর ও পার্থ দাকে বলব, মানবিকভাবে শিক্ষকদের বিষয়টি দেখতে৷ তাঁদেরও বদলি, প্রমোশন পলিসি নিয়ে একটু বিবেচনা করুন৷ কারণ তাঁদের সমস্যা হয়৷ সঙ্গে সঙ্গে নিজের আপনারা এডজাস্ট করে নিতে পারেন৷ ধরা যাক যদি কোন স্কুলে ১০ জন শিক্ষক আছেন, স্টুডেন্ট নেই৷ পাশে একটা স্কুলে একশটা পড়ুয়া আছে টিচার নেই৷ সেখানে শিক্ষকরা চলে যান না৷ এই এডজাস্টমেন্ট শিক্ষকরা নিজেদের মধ্যে করে নিতে পারেন৷ যদি বাঁকুড়া থেকে মেদিনীপুরে শিক্ষকদের বদলি করা হয়, তাহলে তাঁদের সমস্যা হতে পারে৷ সত্যিই এটা সমস্যা৷ আপনারা চেষ্টা করুন৷ আর নিজেদের মধ্যে সমস্যা মিটিয়ে ফেলুন৷’’
শিক্ষকদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘শিক্ষকদের নিশ্চয়ই ডিমান্ড থাকবে৷ তাঁদের প্রবলেম থাকবে৷ আরও পাওয়ার আশা থাকবে৷ আরও উন্নতি আশা থাকবে৷ আস্তে আস্তে নিশ্চয় দেব৷ যখন যেটা হবে, তখন আমরা নিশ্চয়ই করব৷ তবে, ভুল বুঝবেন না৷ কারও কথা শুনে চট করে ভুল বুঝে কিছু করবেন না৷ শুধু এটুকু জেনে রাখবেন, আমি যতটুকু করি নিঃস্বার্থভাবে করি৷ আমার কিছু পাওয়ার নেই৷ আমি যতদিন থাকব, মানুষের জন্য কাজ করব৷’’
প্রায় ৮০ জন শিক্ষককে শিক্ষকের হাতে ‘শিক্ষারত্ন’ পুরস্কার তুলে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ মুখ্যমন্ত্রী নিজে শিক্ষকদের উত্তরীয় পরিয়ে দেন৷ তুলে দেন স্মারক৷ এই প্রথম রাজ্য সরকারের ‘শিক্ষারত্ন’ প্রদান অনুষ্ঠানে পড়ুয়াদের উপস্থিতি কমিয়ে বেশি মাত্রায় শিক্ষকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে৷ যদিও রাজ্য সরকারের শিক্ষা দপ্তরের এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ ঘিরে তৈরি হয়েছে বিতর্ক৷ শিক্ষক সংগঠনের একাংশের অভিযোগ, তারা অনেকেই আমন্ত্রণপত্র পাননি৷ উল্টে তৃণমূল প্রভাবিত শিক্ষক সংগঠনের উপস্থিতি যথেষ্ট বেড়েছে বলেই অভিযোগ শিক্ষকদের একাংশ৷ সরকারি অনুষ্ঠানে ‘আমরা-ওরা’ ঘিরে তৈরি হয়েছে বিতর্ক৷