শুধু শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের জন্য নয়, শিক্ষার সার্বিক প্রয়োজনে আবেদনের ভিত্তিতে বদলি প্রক্রিয়ার দ্রুত বাস্তবায়ন চাই

শুধু শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের জন্য নয়, শিক্ষার সার্বিক প্রয়োজনে আবেদনের ভিত্তিতে বদলি প্রক্রিয়ার দ্রুত বাস্তবায়ন চাই

কিংকর অধিকারী:  বাধ্যতামূলক নয়, শিক্ষক শিক্ষাকর্মীদের আবেদনের ভিত্তিতে নিজের বাসস্থানের কাছাকাছি এলাকার বিদ্যালয়ে বদলির দাবি দীর্ঘদিনের। দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিগত রাজ্য সরকার মিউচুয়াল ট্রান্সফার প্রক্রিয়া চালু করেছিল। কিন্তু আবেদনের ভিত্তিতে বদলি প্রক্রিয়া তারা চালু করেনি। ২০১১ সালে নতুন সরকার নির্বাচিত হওয়ার পর আবার এ দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত আবেদনের ভিত্তিতে বদলির দাবিটি মেনে নেন তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রী ব্রাত্য বসু। এই দাবি মান্যতা পাওয়ায় সরকারকে অন্তর থেকে স্বাগত জানিয়েছিল শিক্ষক শিক্ষাকর্মী সমাজ। কিন্তু প্রতিবছর নিয়োগের সাথে সাথে বদলি প্রক্রিয়া চালু থাকার প্রতিশ্রুতি থাকলেও ২০১৪ সালে একবার মাত্র আবেদনের ভিত্তিতে জেনারেল ট্রান্সফার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল। তারপর নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধের সাথে সাথে বদলি প্রক্রিয়াও থমকে যায়। এরমাঝে স্পেশাল ট্রান্সফারের নামে বেশকিছু বদলি হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের হলেও সত্যি এই বদলির ক্ষেত্রে শোনা গিয়েছে চরম দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের ঘটনা। এছাড়া বাধ্যতামূলক বদলির নামে কিছু শিক্ষককে ইচ্ছাকৃতভাবে দূরের বিদ্যালয়ের বদলি করে দেওয়া হয়েছে যা ছিল প্রতিহিংসাপরায়ণ। কোনোভাবেই তা কম্য নয়। মিউচুয়াল ট্রান্সফারের ক্ষেত্রে বিরাট বাধা ছিল কাস্ট নিয়ে। শেষ পর্যন্ত এই কাস্টের বাধা উঠে যাওয়ার ফলে বহু শিক্ষক শিক্ষিকা মিউচুয়াল ট্রান্সফারে সুযোগ পেয়েছেন। তবে একথা সত্যি কেবলমাত্র মিউচুয়াল ট্রান্সফারের মাধ্যমে শিক্ষক শিক্ষাকর্মীদের প্রকৃত সমস্যা মিটবে না। তার জন্য প্রয়োজন আবেদনের ভিত্তিতে ট্রানস্ফার প্রক্রিয়াকে অবিরত সচল রাখা। গত বিধানসভা নির্বাচনের পূর্বে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্য অনলাইন মিউচুয়াল ট্রান্সফার চালু হলেও অত্যন্ত অন্যায় ভাবে শিক্ষাকর্মীদের অনলাইন মিউচুয়াল ট্রান্সফারের প্রক্রিয়া চালু করা হয়নি। বর্তমানে শিক্ষাকর্মী এবং সমস্ত স্তরের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বদলি প্রক্রিয়াটি অনলাইনের মাধ্যমে কার্যকরী করার একটা ইঙ্গিত মিলেছে কিন্তু এখনো পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি। সমস্ত শিক্ষক শিক্ষাকর্মীদের আবেদনের ভিত্তিতে বদলি প্রক্রিয়াটিকে অতি দ্রুততার সঙ্গে কার্যকরী করার প্রয়োজন রয়েছে বেশ কয়েকটি কারণে। মনে রাখতে হবে, তা কেবল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্য নয়, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যেও এই বদলি প্রক্রিয়া অত্যন্ত জরুরি এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়। কেন এ কথা বলছি, সেটা এবার আলোচনা করে দেখা যাক।

প্রথমতঃ কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, অন্যান্য অফিস, ব্যাঙ্ক, পোষ্ট অফিসের ক্ষেত্রে যত্র তত্র বদলি নীতি রয়েছে। তাহলে বিদ্যালয়ে তা থাকবে না কেন? এর উত্তরে বলি, মনে রাখতে হবে শিক্ষকতার পেশার সাথে অন্যান্য পেশার তুলনা ঠিক নয়। স্পনসর বা এডেড স্কুলগুলি কিন্তু পুরোপুরি সরকারী নয়। সে প্রশ্ন তোলার আগে স্কুল শিক্ষক শিক্ষাকর্মীদের সরকারী কর্মচারীদের মতো সমস্ত সুযোগ দেওয়ার বন্দোবস্ত করা দরকার।

তাছাড়া একথা আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি যে, ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলেই শিক্ষার যথার্থ পরিবেশ গড়ে ওঠে। এ চিন্তা কেবল ব্যক্তি চিন্তা নয়, বরেণ্য শিক্ষাবিদগণও তাই মনে করেন। শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ বিদ্যালয়ের কাছাকাছি থাকলে বিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনের সময় বাদ দিয়েও অন্যান্য সময়টা যেহেতু তিনি সেই এলাকায় থাকেন এর ফলে শিক্ষকের সাথে এলাকার ছাত্র ও অভিভাবকদের একটা নিবিড় যোগাযোগ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরী হয়। দীর্ঘ সহাবস্থানের ফলে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সকলের মধ্যে আচার আচরণের একটা নির্দিষ্ট মানদণ্ড তৈরী হয় যা গোটা এলাকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের উন্নতিতেও সাহায্য করে। একই এলাকা বা পাশাপাশি এলাকায় থাকার ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা অনেকটা সংযত থাকে। সার্বিকভাবে উন্নত সামাজিক পরিবেশ গড়ে ওঠার কিছুটা হলেও সম্ভাবনা থাকে। তাই অন্যান্য পেশার সঙ্গে শিক্ষক শিক্ষাকর্মীদের বদলির বিষয়টিকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক না।

দ্বিতীয়তঃ- বর্তমান কভিড পরিস্থিতিতে বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা কবে স্বাভাবিক হবে আমরা কেউ জানিনা। সরকার ধীরে ধীরে এই সুযোগে শিক্ষাব্যবস্থাকে অনলাইন বা ই-লার্নিং ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থাকে কার্যকরী করিয়ে নিতে পারলে বিদ্যালয় কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে অকার্যকরী হিসাবে পরিগণিত করা যাবে। ফলে আগামী দিনে এত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হবে না। এত শিক্ষক নিয়োগেরও প্রয়োজন হবে না। বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানে অনলাইনের মাধ্যমে ছাত্র ছাত্রীরা বাড়িতে বসে শিক্ষা গ্রহণ করবে। এই নীতি কার্যকরী হলে শিক্ষা ব্যবস্থায় সমূহ বিপদ! শিক্ষা যে all-round ডেভলপমেন্ট, তাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের সামাজিক, মানসিক, সাংস্কৃতিক বিকাশ দারুণভাবে ব্যাহত হবে। তাতে অবশ্য সরকারের লাভ। প্রাথমিক স্তরে যখন ইংরেজি এবং পাশ ফেল প্রথা তুলে দেওয়া হয়েছিল তখন অনেকেই আমরা সরকারের মূল উদ্দেশ্যটা ধরতে পারিনি। ফলে এক ধাক্কায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি ছাত্র-অভিভাবকদের কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়লো। পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অধিকাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলি দ্রুত শ্রীহীন হয়ে পড়ল। সচেতন এবং আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্ন অভিভাবকগণ সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে প্রায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এই সরকারই বদান্যতায়। বর্তমানে প্রায় ৫৪০০০ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রমরমিয়ে চলছে সারা পশ্চিমবঙ্গে। সরকার তার দায় কীভাবে ছেড়ে দিল দেখুন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে নতুন করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলার পরিবর্তে ছাত্রাভাবের অজুহাতে একে একে তা বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে চলেছে সরকার। একই ভাবে আজ মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে গুরুত্বহীন করে অনলাইন বা ই-লার্নিং ব্যবস্থাকে কার্যকরি করে নিতে চাইছে সরকার। একে প্রতিহত করতে গেলে শিক্ষক শিক্ষাকর্মীদের নিজের এলাকার বিদ্যালয়ের কাছে বদলির দাবিটিকে জোরালো করতে হবে এবং কভিড পরিস্থিতিতে নিজেদের এলাকায় থাকলে নিয়মিত পাঠদানের প্রক্রিয়াকে সুনিশ্চিত করা আরো বেশি সুবিধাজনক হবে। সরকারের এই ষড়যন্ত্রকে রুখে দেওয়া যাবে।

তৃতীয়তঃ বহু শিক্ষক, শিক্ষিকা শিক্ষাকর্মী তাঁদের বৃদ্ধ পিতা-মাতা, পরিবার, পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূর দূরান্তে কালাতিপাত করছেন। অথবা পারিবারিক কারণে বাধ্য হয়ে প্রতিদিন বহুদূরে অবস্থিত বিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে। ফলে সকাল থেকে প্রায় রাত পর্যন্ত প্রতিদিনের এই যাতায়াতের ধকল দেহে এবং মনে ক্লান্তি আনে। এই অবস্থায় কোন শিক্ষক বা শিক্ষিকা কি তার নিজের সবটা ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য উজাড় করে দিতে পারে? প্রতিদিনের এই বিরাট দূরত্ব অতিক্রম করার ফলে অনেকটা এনার্জি নষ্ট হয়ে যায়। ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তার কুপ্রভাব পড়তে বাধ্য। তাই ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার প্রয়োজনে শিক্ষক শিক্ষিকাদের নিজের বা কাছাকাছি এলাকায় বদলি অত্যন্ত জরুরি।

আর শিক্ষাকর্মীগণ হলেন বিদ্যালয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিদ্যালয়ে সবার প্রথমে উপস্থিত হতে হয় তাঁদের। আবার সবার শেষে বিদ্যালয় থেকে বাহির হন তাঁরাই। যখন তখন জরুরী প্রয়োজনে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে হয় তাঁদের। বিদ্যালয়ের প্রয়োজনেই তাঁদের নিকট অবস্থান যে কত জরুরি তা আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করি। তাই সুষ্ঠুভাবে বিদ্যালয় পরিচালনা এবং শিক্ষার পরিবেশ ধরে রাখতে গেলে শিক্ষক শিক্ষাকর্মীদের নিজের এলাকার বিদ্যালয়গুলিতে বদলির সুযোগ করে দেওয়াটা অত্যন্ত জরুরী নয় কি?

কেউ কেউ বলেন, বাধ্যতামূলক বদলি হলে একঘঁয়েমি কাটবে বা জীবনে বৈচিত্র্য আসবে। আর এর দ্বারা দক্ষ প্রধান শিক্ষকরা বিভিন্ন স্কুলে নিজেদের পারফরমেন্স প্রয়োগ করে বিদ্যালয়ের সামগ্রিক মানোন্নয়ন ভূমিকা নিতে পারবেন। আর মৌরসিপাট্টা কায়েম করা প্রধান শিক্ষকরা এক জায়গায় দীর্ঘদিন থাকলে যন্ত্রনা বাড়ে। তাই এই বদলিটা ওঁদের জন্যও জরুরী। যাঁরা এই মত পোষণ করেন তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি, বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলুন তো আপনি যেভাবে ভাবছেন সরকার কি সেই দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে এ কাজ করবে? এই নিয়মের জেরে সরকারি বদান্যতায় কেউ তাঁর পছন্দ মতো জায়গায় বদলি নিয়ে হাসতে হাসতে চলে যাবেন, আর কাউকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে জেলা থেকে জেলান্তরে। বলার অপেক্ষা রাখে না কার ক্ষেত্রে পুরস্কার আর কার ক্ষেত্রে তিরস্কার জুটবে। আর মৌরসিপাট্টা কায়েম করা প্রধান শিক্ষকরা শাসকদলের ছত্রছায়ায় থেকেই এ কাজ করেন। এঁদের কপালে যে বরাবর পুরস্কারই থাকে তার নজির আশা করি নতুন করে দিতে হবে না। চোরের উপর রাগ করে আমরা কি মাটিতে ভাত খাবো? বিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে তাই বাধ্যতামূলক বদলি নয়, আবেদনের ভিত্তিতে শিক্ষক, শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মীদের বাসস্থানের কাছাকাছি বিদ্যালয়ে বদলির সুযোগ করে দেওয়া দরকার শিক্ষার স্বার্থেই। তাই আর কালবিলম্ব নয়, অতি দ্রুত স্বচ্ছতার সাথে অনলাইন প্রক্রিয়ায় বদলি ব্যবস্থা কার্যকরী হোক। সরকার টালবাহানা করলে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীগণ পথে নামার জন্য প্রস্তুত হোন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × four =