উস্থি ইউনাইটেড প্রাইমারি টিচার্স এসোসিয়েশনের ডাকে বিকাশ ভবনের অদূরে চলছে প্রাথমিক শিক্ষকদের অনশন৷ টানা এক সপ্তাহ ধরে চলছে অনশন৷ কিন্তু, শিক্ষকদের অবস্থান বিক্ষোভ আট দিন কেটে যেতে চলেও এখনও দেখা মেলেনি শিক্ষা দপ্তরের আধিকারিকদের৷ উল্টে শিক্ষামন্ত্রী দিয়েছেন কড়া হুঁশিয়ারি৷ তবে, সরকারি হুমকি উপেক্ষা করে আজও অনড় অনশনরত শিক্ষকরা৷ ইতিমধ্যেই শিক্ষকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বিরোধী রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সমাজের বুদ্ধিজীবী মহল৷ এবার শিক্ষকদের সমস্যা মেটাতে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ঠিচি পাঠালেন বাম পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তী৷
মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়ে সুজন চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘‘আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে কলকাতার উপকন্ঠে সল্টলেকে বিকাশ ভবনের পাশে গত সাতদিন ধরে আমাদের রাজ্যের শিক্ষকরা অনির্দিষ্টকালের জন্য অনশনে রয়েছেন৷ সরকার নির্বাক, নিশ্চুপ৷ গত সাত দিনের মধ্যে একবারও সরকারের পক্ষ থেকে কোন মন্ত্রী তাঁদের দেখা করা নূন্যতম সৌজনতা দেখাতে পারেনি৷ এটা অবশ্যই নিন্দা ও লজ্জার৷ যে দাবিতে প্রাথমিক শিক্ষকরা বসতে বাধ্য হয়েছেন, সেই দাবি যুক্তিযুক্ত৷ সর্বভারতীয় যোগ্যতা মানে সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েই যাঁরা শিক্ষকতা কাজে নিযুক্ত আছেন, সর্বভারতীয় বিচারে তাঁদের বেতন কাঠামো বৃদ্ধির ন্যায্য দাবি রয়েছে৷ তা আপনি নিশ্চয়ই বুঝবেন৷ কিন্তু, তাঁদের ন্যায্য দাবিকে মান্যতা দেওয়ার পরিবর্তে সরকার বরং চূড়ান্ত উদাসীন৷ হুমকি দিচ্ছে৷ শাস্তির জন্য নির্দেশিকা জারি করছে৷ এটা মেনে নেওয়া যায় না৷ সরকার তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি মূলক প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে৷ প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও তা এখনও পর্যন্ত করা যায়নি৷ স্বভাবতই সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্রমশ কমছে৷ সংবেদনশীল সমাজে স্বাভাবিকভাবেই নিন্দার ঝড় উঠেছে৷ অমানবিক মনোভাব সুশীল সমাজ এরকম অমানবিক আচরণ মেনে নিতে পারছে না৷ প্রসঙ্গত স্কুল সার্ভিস কমিশনে পাস করা চাকরিপ্রার্থীরা ২৯ দিন ধরে অনশন করেছিল৷ তাঁদের কথা সরকারের কোন পৌঁছায়নি৷ শেষ পর্যন্ত আপনি গিয়ে তাঁদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন৷ তাঁরা অনশন প্রত্যাহার করে নিয়েছে৷ কিন্তু তারপর চার মাস অতিক্রম হতে চলল৷ সরকার আজও তাঁদের দাবি মানা দিতে পারেনি৷ আপনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী৷ যথাযথ দায়িত্ব নিন৷ অবিলম্বে আন্দোলনরত, অনশনরত শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলুন৷ তাঁদের সমস্যা মেটানো জন্য আপনার কাছে আমাদের অনুরধ, জরুরি ভিত্তিতে যথাযথ ব্যবস্থা নিন৷
অন্যদিকে, অনশনকারী প্রাথমিক শিক্ষকদের পাশে দাঁড়িয়ে বিবৃতিও দিয়েছেন কবি শঙ্খ ঘোষ৷ লিখেছেন, ন্যায্য দাবি নিয়েই সরকারের দ্বারস্থ হয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষক-শিক্ষিকারা৷ কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের মৌখিল প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা পূরণ করতে চাননি বা পারেননি সরকারপক্ষ৷ এটা দুর্ভাগ্যের যে অন্য রাজ্যের তুলনায় এ রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষকরা কম বেতন পান৷ সেই সমস্যার সুরাহা না হওয়াতেই আজ আন্দোলনে সামিল হয়েছেন তাঁরা৷ চোখের সামনে এ রাজ্যে এমনটা হচ্ছে এটা লজ্জার৷ গত পাঁচদিন (এখন ৭ দিন) ধরে অনশন করছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা৷ ১৮ জন ইতিমধ্যেই আমরণ অনশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ এসব দেখেটাও বড় অসহায় ব্যাপার৷ তবে এটাই আশা যে আগামী দিনে হয়তো সরকারপক্ষ এই সমস্যার সমাধান করবেন৷
কিন্তু, এতকিছুর পরও নিরুত্তাপ প্রশাসন৷ উল্টে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘শিক্ষকদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক৷’ কিন্তু শুভবুদ্ধির উদয় হাওয়ার বার্তা দিলেও আর কতদিন পর মিটবে শিক্ষকদের সমস্যা? আর কতদিন রাজপথে পড়ে থাকতে হবে শিক্ষকদের? আর কত শিক্ষক অসুস্থ হওয়ার পর ঘুম ভাঙবে শিক্ষকদের? ১৮ অশনকারীর মৃত্যু পর কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে? উস্থি ইউনাইটেড প্রাইমারি টিচার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদিকা পৃথা বিশ্বাস বলেন, ‘‘আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে সাত দিনের ধর্না ও ছ’দিনের অনশন চালিয়ে যাচ্ছি৷ ১৮ জন শিক্ষক অনশন করছেন৷ শিক্ষকদের দাবি না মিটলে এই ১৮ জন শিক্ষকের মৃত্যুর দায় সরকারকে নিতে হবে৷’’
শিক্ষকদের এই আন্দোলন প্রসঙ্গে প্রথমিক শিক্ষক রাজ বর্মা বলেন, ‘‘উস্থি একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। আমরা এখানে অনশনে বসেছি৷ আমাদের ন্যায্য অধিকার ও আমাদের ১৪ জন সহকর্মীর অনৈতিক বদলির বিরুদ্ধে৷ আমাদের দাবি দুটি৷ প্রথমত প্রাথমিকে সর্বভারতীয় বেতনক্রম চালু অর্থাৎ PB4 যার গ্রেড পে হবে ৪২০০ টাকা৷ দ্বিতীয়ত, আমাদের যে ১৪ জন সহকর্মীকে অনৈতিকভাবে ৪০০-৬০০ কিমি দুরে বদলি করা হয়েছে, তাঁদের আগের স্কুলে ফিরিয়ে আনা৷ অনশনের ৬ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পথে৷ তবুও সরকারের পক্ষ থেকে কোনও সদর্থক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি৷ এমনকি জল, টয়লেটেরও ব্যবস্থা করা হয়নি প্রশাসনের৷ একটা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে আমরা আমাদের অনশন চালিয়ে যাচ্ছি৷ আমাদের দাবি যতদিন মেনে হবে না ততদিন আমরা আমাদের অনশন চালিয়ে যাব৷’’
যোগ্যতা বাড়লেও বাড়েনি বেতন৷ ঝুলে মহার্ঘ ভাতা মামলা৷ বাড়ানো হয়েছে ষষ্ঠ বেতন বেতন কমিশনের মেয়াদ৷ বেতন বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে পুলিশি তাণ্ডবের শিকার হতে হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষকদের বড় অংশকে৷ যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন বৃদ্ধি ও বদলির নির্দেশের বিরুদ্ধে চলছে সাত দিনের ধর্না ও ছ’দিনের অনশন৷
কিন্তু কেন এই সমস্যা? জানা গিয়েছে, ২০০৪ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে প্রাথমিক স্কুলে চাকরি পেয়েছিলেন৷ রাজ্য সরকারের সেই সময়কার নিয়ম অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষক হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল মাধ্যমিক৷ পরে ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর টিচার্স এডুকেশনের বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানায়, প্রাথমিক স্কুলে চাকরি পেতে গেলে ন্যূনতম যোগ্যতা হিসেবে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ হতেই হবে৷ থাকতে হবে দু’বছরের শিক্ষণ প্রশিক্ষণ৷ ২০১২-য় রাজ্য এ ব্যাপারে বিজ্ঞপ্তি জারি করে৷ কিন্তু নিয়ম মেনে যোগ্যতা বাড়লেও পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্ধারিত ৯৩০০ থেকে ৩৪৮০০ টাকা বেতনহার তাঁদের দেওয়া হচ্ছে না৷ আর এরই প্রতিবাদে বারংবার রাজপথে নামেন কয়েক হাজার শিক্ষক৷ এবার রাজপথে আগলে অধিকারের দাবিতে ফুটপাতে পড়ে রয়েছেন কয়েক হাজার শিক্ষক৷ কবে মিটবে এই সমস্যা? স্কুল ছেড়ে কেন রাস্তায় পড়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন শিক্ষকরা? উঠছে প্রশ্ন৷