সুনন্দা বারুই: বিনোদন জগতে একটি নতুন ধরণের কাজের সুযোগ দ্রুত বাড়ছে। এটি হল প্রতিটি প্রোডাকশন হাউসের সেটে একজন 'ইন্টিমেসি কোঅর্ডিনেটর' (অন্তরঙ্গ সমন্বয়ক)-এর উপস্থিতি। মূলত “মি টু”-এর অনুপ্রেরণায় টেলিভিশন বা চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে যুক্ত নগ্নতা বা যৌনতার দৃশ্যে কাজের ক্ষেত্রে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অস্বস্তি দূর করতে ও শোষণের হাত থেকে সুরক্ষিত রাখতে এই পেশায় যেমন আছে নতুনত্ব, তেমনই রয়েছে প্রতিবাদের প্রসস্ত পরিসর। এই কাজে যুক্ত হতে শিক্ষাগত যোগ্যতার সঙ্গে প্রয়োজন বিশেষ প্রশিক্ষণের যা হতে পারে কয়েক মাসব্যাপী।
তাঁর আগে “মি টু” নিয়ে একটা ধারণা দেওয়া যাক। ভারতে 'মি টু' আন্দোলনটি আন্তর্জাতিক “মি টু” আন্দোলনের একটি বহিঃপ্রকাশ যা ২০১৮-র শেষদিকে (এবং আজও অব্যাহত রয়েছে) সরকার, মিডিয়া এবং বলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিসহ ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিফলিত। ভারতে, 'মি টু' আন্দোলনকে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অভিযান দ্বারা প্রভাবিত একটি স্বাধীন প্রচার বা আমেরিকান “মি টু” সামাজিক আন্দোলনের একটি শাখার প্রভাব বলা যায়। “মি টু” আন্তর্জাতিক আন্দোলন ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় আন্দোলন হিসেবে ভারতে খ্যাতি অর্জন করতে শুরু করেছিলেন ।
নিউইয়র্কের সমাজকর্মী তারানা বুর্ক, সমাজে নারীদের প্রতি যৌন হেনস্থা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০০৬ সালে প্রথমবার “মি টু” শব্দটি ব্যবহার করে স্যোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে একটি আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। ২০১৭ সালে চলচ্চিত্র নির্মাতা সার্ভে উইনস্টেইনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে অন্তত ৮০জন মহিলাকে মৌন নিপীড়ন, ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এদের মধ্যে ১২জনের দায়ের করা অভিযোগকে কেন্দ্র করে সেই সময় #MeToo আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ে স্যোশাল মিডিয়ায়। এরপর ভারতে এই সংগঠন সমাজের উচ্চপদস্থ ব্যাক্তিত্বদের কুকর্মের বিরুদ্ধে শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে ওঠে ২০১৮ সালের অক্টোবরে অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্ত স্বনামধন্য অভিনেতা নানা পাটেকরের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগকে কেন্দ্র করে। সেই প্রথম মুম্বাইয়ে বলিউডের বিনোদন জগতে “মি টু”-এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর এই সংগঠনের তৎপড়তায় ভারতীয় সংবাদমাধ্যম, চলচ্চিত্র জগৎ, এমনকি সরকারি ক্ষেত্রেও বহু মহিলার যৌন হয়রানির অভিযোগের প্রেক্ষিতে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছিল প্রশাসনকে। অভিনেতা অলোক নাথ থেকে শুরু করে সাংবাদিক এম জে আকবরের মত নামী ব্যক্তিদের যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের অনেক গল্প সামনে এনেছে এই “মি টু”।
হলিউডের যৌন হয়রানি ও লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে “মি টু” আন্দোলন চলচ্চিত্র শিল্পে নজিরবিহীন পরিবর্তন এনেছে।বিনোদন জগতে 'ইন্টিমেসি কো-অর্ডিনেটর' পদটি এই পরিবর্তনেরই বাস্তবিক রূপ। হলিউডে ইতিমধ্যেই এই কাজের কদর ও চাহিদা দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে।বছর তিনেক আগেও চলচ্চিত্রে যৌন দৃশ্যে অভিনয়ের সময় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা প্রকৃত অর্থেই প্রচন্ড মানসিক চাপ ও অসহায় বোধ করতেন কিন্তু একজন 'ইন্টিমেসি কো-অর্ডিনেটর'এর উপস্থিতি এই কাজটি অনেক সহজ করে দিয়েছে।
দিনের পর দিন খাওয়া-ঘুম ভুলে একটি ছবির একটি চরিত্রে নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে হয়। আর চলচ্চিত্র জগতে এমন পরিবেশে খুব স্বাভাবিক যেখানে সময় আক্ষরিক অর্থেই অর্থহীন এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীদের একজন পরিচালকের সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখেই কাজ করতে হয়, সেখানে তাদের অস্বস্তি তো দূরের কথা, তারা যা করতে চান না এমন দৃশ্যে কাজ করতেও রাজি হতে হয়। পরে এমনটাও হয় যে দৃশ্যের সেই অংশটি নিয়ে তারা হীনমন্যতায় ভোগেন। কাজের ক্ষেত্রে এ একপ্রকার মানসিক হেনস্থা বৈকি? তাই কাজ করতে গিয়ে নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা প্রয়োজনের গুরুত্ব পেতে বাধ্য হয়ে অনেকেই আইনজীবীর দ্বারস্থ হতে হয়। তবে একজন ইন্টিমেসি কোঅর্ডিনেটর এই পুরো সমস্যা সমাধানের মাধ্যম হয়ে উঠেছেন।
ইন্টিমেসি কো-অর্ডিনেটর(ঘনিষ্ঠতা সমন্বয়কারী)-দের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়, এলজিবিটিকিউ কাস্ট সদস্য এবং অভিনেতাদের পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করতে হয়, অভিনেতা ও প্রযোজনা এই দুইয়ের মধ্যে স্বচ্ছ যোগসুত্র এবং মতের মিল সহজ করে তুলতে সহায়কের কাজ করতে হয়। দৃশ্য সংক্রান্ত নগ্নতা এবং কৃত্রিম যৌনতা সম্পর্কিত কাজের সঠিক নিয়মবিধির আনুগত্য নিশ্চিত করতে হয়। এবং পরিচালকের অনুরোধে প্রয়োজনে কোরিওগ্রাফার এবং কোচ সরানোর কাজও করতে হয়।
হলিউডে এই কাজের চাহিদা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও এদেশে এই কাজ নিয়ে সেই অর্থ স্বচ্ছতা বা শক্ত ভিত গড়ে উঠতে সময় লাগবে। তবে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিনোদন জগতে এই নতুন পদে নিয়োগ নিয়ে আলোচনাও শুরু হয়েছে। বিশ্বায়নের যুগে তাই ভারতীয়দের কর্মসংস্থানের তালিকায় 'ইন্টিমেসি কো-অর্ডিনেটর'-এর পদের জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দেওয়াই যায়। আর একান্তই এদেশে না হলে বিদেশে কাজের সুযোগ করে দিতে পারে এই কাজ। তবে শেষে “মি টু”-এর কথা আরও একবার মনে করতেই হবে। কারণ নারী দিবসে এদের অবদানের স্বীকৃতি দিতেই হবে প্রতিবাদী ভূমিকায়। আর এই নতুন কাজের দিশা তো এদের দৌলতেই। যেখানে কাজের পাশাপাশি প্রতিবাদের একটা পোক্ত এবং বিস্তৃত জায়গা পাওয়া যাবে, বিশেষত মহিলাদের জন্য।