কলকাতা: শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি৷ সিএজি রিপোর্টকে হাতিয়ার করে এবার বড়সড় আন্দোলনে নামছে বিজেপি৷ বিষয়টি সংসদে তুলে ধারাবাহিক আন্দোলনের ঘোষণা গেরুয়া শিবিরের৷ আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে কলকাতা-সহ সারা রাজ্যজুড়ে আন্দোলনের ঘোষণা বিজেপি নেতা সায়ন্তন বসুর৷
মঙ্গলবার রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু সাংবাদিক বৈঠক করে বলেন, ‘‘সিএজি রিপোর্টে প্রকাশ হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের আমলে৷ রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে৷ আর তৃণমূল সরকারের আমলে এই শিক্ষক দুর্নীতির অভিযোগ রাজ্য বিজেপি আইনি লড়াইয়ে নামবে৷’’ এমনকী, রাজ্যের শিক্ষক দুর্নীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে দিল্লিতেও আওয়াজ তোলার বার্তাও দিয়েছেন সায়ন্তন৷ যদিও, সোমবার এই বিষয়ে সাংবাদিক বৈঠক করে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, সিএজি রিপোর্টে যে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে তা বাম আমলে৷ এই বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ ও তদন্তের জন্য স্কুল সার্ভিস কমিশনকে রিরোর্টও তদব করেছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়৷ তবে, শিক্ষামন্ত্রীর তদন্তের অভিযোগ উড়িয়ে সাংবাদিক বৈঠক করে সায়ন্তন বসু জানান, লোকসভায় দলের ১৮ জন সাংসদ এবিষয়ে সংসদে প্রশ্ন তুলবেন৷ রাজ্যজুড়ে হবে আন্দোলন৷
রাজ্যের শিক্ষামমন্ত্রীর দাবি উড়িয়ে পাল্টা সায়ন্তন বসু জানান, ২০১৭ সালের ৩১ মার্চ সিএজি তার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে৷ সেই সময়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভটাচার্য ছিলেন না বলেও পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে কটাক্ষ করেন সায়ন্তন৷
শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে চরম কেলেঙ্কারির প্রমাণ পেয়েছে কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অব ইন্ডিয়া বা ক্যাগ৷ ক্যাটের সম্প্রতিক রিপোর্টে রাজ্য সরকারের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া এখন প্রশ্নের মুখে৷ ক্যাগের তরফে তথ্য প্রমাণ পেশ করে স্কুল সার্ভিস কমিশনের সহকারি শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে বলে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ ক্যাগের এই রিপোর্ট প্রকাশ ও সংবাদমাধ্যমে তা প্রকাশিত হওয়ার পর বাম আমালে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা করলেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়৷
সোমবার সাংবাদিক বৈঠক করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘‘আমরা সমস্ত বিষয়টি দেখছি এবং আমি অলরেডি এসএসসিকে বলেছি, ওই সময়ে সমস্ত কাগজপত্র বের করে আপনারা আমাদের দপ্তরকে রিপোর্ট করবেন৷ আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব৷ এবং সিএজি অডিট রিপোর্ট যদি বিধানসভায় তোলা হয়, তার আগে আমরা যেন তৈরি থাকি৷ আমরা এবিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেব৷’’
শিক্ষক নিয়োগের তদন্তের বিষয়ে স্কুল সার্ভিস কমিশনকে নির্দেশ দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘‘শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের বিষয়ে আমি এসএসসিকে বলেছি, সংশ্লিষ্ট সমস্ত কাগজপত্র দেখে, যারা এর সঙ্গে যুক্ত আছেন, তাঁদের খুঁজে বার করুন৷ ডাকুন৷ এবং আইনের পথে যতটুকু সাহায্যের দরকার করা যায় তা নিয়ে আমাদের জানান৷ এসএসসির কাছ থেকেই আমরা জানতে চাই ওই সময় কালে, ২০০৮, ২০০৯, ২০১০ এই যে আরএলএসটি হয়েছে, যার খবর কাগজে প্রকাশিত হয়েছে এবং যে কোর্ড এখনও পর্যন্ত বিধানসভায় টেবিল হয়নি, সেটাকে নিয়ে তারা সংবাদমাধ্যমে প্রচার করেছেন৷’’
বলেন, ‘‘আমরা দেখলাম যে কোন একটি সংবাদপত্রে ক্যাগ রিপোর্টকে সামনে রেখে একটি সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে৷ আমরা সেই সংবাদপত্রকে জানিয়েছি, আপনাদের এই পরিবেশিত সংবাদ একটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে৷ দেখে মনে হচ্ছে এটা যেন আমাদের সময় কাল এই এই সমস্ত অনিয়ম হয়েছে৷ আর তাকে কেন্দ্র করে দীলিপবাবু অনেক কথা বলছেন৷ অনেকে আবার মিছিলে করে শাস্তি দাবি করছেন৷ বলছেন কোর্টে যাবেন৷ কালকেই চলে যান৷ আদালতে গিয়ে বিচার চান আপনাদের বিরুদ্ধে৷ কারণ ২০০৮, ২০০৯, ২০১০ ওই সময় আমাদের সরকার তার দায়িত্বে ছিল না৷ ২০১২ যে আরএলএসটি হয়েছে, সেই আরএলএসটি পর্যন্ত সিএজি সেটাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আনেনি৷ যখন আসবে তখন তার উত্তর আমরা নিশ্চয়ই দেব৷ কিন্তু ইতিমধ্যেই খবরের কাগজে বেরিয়েছে তাতে এমন ভাবে বেরিয়েছে, যেন মা মাটি মানুষের সরকারের আমলে এই অনিয়ম করা হয়েছে৷’’
ক্যাগের এই রিপোর্ট প্রকাশ হতেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হলেন বাংলার শিক্ষকদের একাংশ৷ স্কুল সার্ভিস কমিশনের দুর্নীতির প্রসঙ্গে শিক্ষক শিক্ষাকর্মী শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চ রাজ্য সম্পাদক কিংকর অধিকারী বলেন, ‘‘এসএসসি নিয়ে দুর্নীতি যে আমলেই হোক তার যথাযথ তদন্ত ও দোষীদের কঠোর শাস্তি দাবি করছি আমরা৷ এবং বঞ্চিতদের উপযুক্ত সুযোগ দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। ভবিষ্যতে যোগ্যতার ভিত্তিতে ব্যক্তিরা একজনও যাতে বঞ্চিত না হন তা সুনিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষিত বেকারদের জীবন নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেলা বন্ধ হোক৷’’
ক্যাগ রিপোর্টের উল্লেখ করে রবিবার সাংবাদিক বৈঠক করে দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘‘খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় বলার আছে৷ ক্যাগের যে রিপোর্ট এসেছে, আপনারা সবাই জানেন৷ পশ্চিমবঙ্গে বর্তমান রাজনীতির ক্ষেত্রে এটা ভয়ঙ্কর বিষয়৷ যতবার পরীক্ষা হয়েছে, শিক্ষক নিয়োগের প্রত্যেকবার কোন না কোন গণ্ডগোল হয়েছে৷ আর তার পরিণাম এই রিপোর্ট৷ এসএসসিতে ৪.০৭ লক্ষ পরীক্ষার্থীর মধ্যে শিক্ষাগত যোগ্যতার সঠিকভাবে দেয়া হয়নি ৪৬ হাজার প্রার্থীর৷ সঠিকভাবে নাম্বার দেওয়া হয়নি৷ নম্বর বাড়ানো হয়েছে ৩২.৯ শতাংশের৷ ৩৩ হাজার লোকের নম্বর বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷ নম্বর কমানো হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার পরীক্ষার্থীর৷ এটা কত বড় বিশ্বাসঘাতকতা হয়েছে সমাজের কাছে৷ আমাদের যুব সমাজের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে৷ যারা ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য পরিশ্রম করেছেন, তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে৷ যারা গরিব পরিবার, তাঁদের বাবা-মা গয়না বিক্রি করে, জমি বিক্রি করে ছেলেমেয়েদের পড়িয়েছেন৷ কিন্তু, আজ তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে৷ সেই ২০০৯ থেকে এই ছিনিমিনি খেলা চলছে৷ সিপিএমের আমলে শুরু হয়েছিল৷ সেই রোগটা এখন তৃণমূল সরকারের আমলে চলছে৷ ইচ্ছা করে এখানে গন্ডগোল করানো হয়েছে৷ যদি এটা চলতে থাকে তাহলে বাঙালি ভবিষ্যৎ কিন্তু দুর্বল হয়ে যাবে৷ আমরাও এটা দিল্লি পর্যন্ত নিয়ে যাব৷ আমরা সহজে ছাড়বো না৷ কারণ এটা পশ্চিমবঙ্গের মান সম্মান ও ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে৷’’
ক্যাটের ২০১৮ সালের ৬ নম্বর রিপোর্টে বলা হয়েছে, একাদশ শ্রেণিতে সহকারি শিক্ষক নিয়োগে ৩৭৬ জন অকৃতকার্য হয়েছে৷ কিন্তু পরে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে৷ একাদশ শ্রেণিতে সরকারী শিক্ষক নিয়োগে ৪২৬৬ জন পরীক্ষা দিয়েছেন৷ কিন্তু, তাঁরা কোন ভাষায় পরীক্ষা দিয়েছে তা এখনও অজানা৷ দশম ও একাদশে শিক্ষক নিয়োগের ৬৮৯ জনের নাগরিকত্বের কোন উল্লেখ করা হয়নি৷ এদের মধ্যে ১০জনকে আবার নিয়োগপত্র দিয়ে দিয়েছে স্কুল সার্ভিস কমিশন৷ একাদশে শিক্ষক নিয়োগে সিস্টেমে ১২৭২১ জনের শিক্ষাগত যোগ্যতার নম্বর শূন্য৷ কিন্তু প্যানেলে নম্বর ভিন্ন৷ একাদশে শিক্ষক নিয়োগে অনলাইনে ৩৩০৫ জনের নম্বর দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু, প্যানেলে সেই নাম্বর পরিবর্তিত হয়েছে৷ ক্যাগের রিপোর্ট দেখুন এই লিঙ্কে- https://cag.gov.in/sites/default/files/audit_report_files/Chapter_2_Performance_Audits_of_Report_No_6_of_2018_General_and_Social_Sector.pdf
রিপোর্টে বলা হয়েছে, এসএসসি দশম শ্রেণিতে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্য প্রাপ্ত নম্বর অনেক ক্ষেত্রেই কমিয়ে অথবা বাড়িয়ে দিয়েছে৷ উত্তরবঙ্গের ১০ লক্ষ ২ হাজার ৫৯ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১১ হাজার ২১ জনের নম্বরে গরমিল ধরা পড়েছে৷ ৬ হাজার ৫৬১ জনের নম্বর বাড়ানো হয়েছে৷ ৪ হাজার ৪৬০ জনের নম্বর কমানো হয়েছে৷ একাদশে শিক্ষক নিয়োগে এমন ২ হাজার ২৬৪ প্রার্থীর খোঁজ মিলেছে যাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতার নম্বর ১ থেকে ২৪ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷ একাদশে ৭ জন শিক্ষকের জাতী পরিবর্তন করে পর্যন্ত চূড়ান্ত প্যানেলে পরিবর্তন করা হয়েছে বলেও রিপোর্ট পেশ করেছে ক্যাগ৷