কলকাতা: উন্নয়ন ভবন থেকে বিধাননগর মহকুমা হাসপাতাল৷ খুব বেশি হলে এক হাফ কিলোমিটার পথ৷ কিন্তু, সেই দূরত্বে টানা অনশনরত প্রাথমিক শিক্ষিকাকে নিয়ে যেতে জুটল না কোনও অ্যাম্বুল্যান্স৷ বাধ্য হয়েই অধ্যাপকের গাড়িতে তুলে নিয়ে ভর্তি করানো হল হাসপাতালে৷ বেতন বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে পুরুলিয়া থেকে সুদূর কলকাতার রাজপথে বসে অনশনে বসা অসুস্থ শিক্ষিকা মৌসুমী রায়ের অবস্থা আপাতত স্থিতিশিল হতেই ফের ফিরে যান অনশনমঞ্চে৷ কিন্তু, প্রশ্ন উঠছে টানা দু’দিন ধরে যখন শিক্ষককা লাগাতার অনশন কর্মসূচিতে বসেছেন, তখন কেন মেডিক্যাল টিম পাঠিয়ে ক্ষান্ত থাকল প্রশাসন? কেন প্রয়োজনে পাওয়া গেল না অ্যাম্বুল্যান্স? এই নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যেই তৈরি হয়েছে চূড়ান্ত ক্ষোভ৷
জানা গিয়েছে, বেতন বৃদ্ধির দাবি ও ১৪ জন শিক্ষকের বদলির নির্দেশ রুখতে অনশনে বসেন পুরুলিয়া থেকে কলকাতায় আসা শিক্ষিকা মৌসুমী রায় অনশনে বসেন৷ আজ, সকালে শিক্ষকদের অনশন মঞ্চে যান বিজেপি নেতা তথা অধ্যাপক অনুপম হাজরা৷ ছিলেন সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী৷ অনুপম অনশন মঞ্চে থাকাকালীনই ওই শিক্ষিকা অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ ডাকা হয় অ্যাম্বুল্যান্স৷ কিন্তু, প্রয়োজনের সময় তা না পেয়ে অনুপম হাজরার গাড়িতে তুলে ওই শিক্ষিকাকে বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷
উৎসবের পেছনে দেদার অর্থ খরচ করছে রাজ্য সরকার৷ ২ লক্ষ টাকা করে অর্থ দিতেও খামতি নেই সরকারের৷ কিন্তু, রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবি মেটাতে কেন এত অনীহা? ভারতবর্ষে যেখানে প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য নির্দিষ্ট বেতনক্রম বেঁধে দেওয়া হয়েছে সেখানে পশ্চিমবঙ্গে কেন এই বেতন বৈষম্য? মানুষ গড়ার কারিগর যদি সমস্যা থাকে তাহলে কোথায় দাঁড়াবে বাংলার প্রথমিক পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ? একদিকে বেতন বৃদ্ধির দাবি, অন্যদিকে শিক্ষকদেক দূরে বদলির প্রতিবাদ৷ শিক্ষামন্ত্রীর কাছে বারংবার দাবি জানিয়েও সমস্যা সমাধান না হওয়ায় এবার রাজপথ আগলে টানা দু’দিন ধরে অনশনে বসলেন প্রাথমিক শিক্ষকদের একাংশ৷ ইতিমধ্যেই তিন জন অসুস্থ্য৷
শিক্ষকদের দাবি পূরণ না হওয়ার কারণেই রাজপথে অনশনে বসলেন প্রাথমিক শিক্ষকরা৷ যতক্ষণ না পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধি দাবি ও বদলির নির্দেশ প্রত্যাহার করা হচ্ছে, ততক্ষণ এই অনশন কর্মসূচি চবলে বলে জানা গিয়েছে৷ শুক্রবার দিনভর বিক্ষোভ, রাতভর ধর্নার পর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিন জন শিক্ষিকা৷ এবার নতুন করে অনশন কর্মসূচির ঘোষণায় বেশ বিপাকে রাজ্য শিক্ষা দপ্তর৷ উন্নয়ন ভবনের সামনে আজ দুপুর একটা থেকে শুরু হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষকদের অনশন কর্মসূচি৷
তবে, শিক্ষকদের এহেন অন্দোলন ভালো চেখে দেখছে না রাজ্য৷ সাংবাদিক বৈঠক থেকে রাজ্য সরাকারের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়৷ যে প্রাথমিক শিক্ষকরা বেতনের গ্রেড নিয়ে আন্দোলন করছেন তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ইঙ্গিত দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী৷ উন্নয়ন ভবনের সামনে অবস্থান করা শিক্ষকদের ক্ষেত্রে কড়া মনোভাব দেখানো হবে বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রী৷ এই শিক্ষকরা ছুটি না নিয়ে এসে অবস্থান করে থাকলে তাঁদের বেতন কাটা যেতে পারে বলেও ইঙ্গিত মিলেছে৷ শিক্ষা দপ্তর যদি আন্দোলনরত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, তাহলে শিক্ষকদের তরফে চূড়ান্ত আন্দোলনেরও হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখা হয়েছে৷
শুক্রবার দিনভর বেতন বৃদ্ধি ও বদলির নির্দেশ প্রত্যাহারের দাবিতে মিছিল করেন প্রাথমিক শিক্ষকদের একটি বড় অংশ৷ কয়েক হাজার প্রাথমিক শিক্ষক বিকাশ ভবনের বিক্ষোভ দেখান৷ দীর্ঘ দিন ধরে দাবি জানিয়ে আসা প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির দাবি মেটানোর বিজ্ঞপ্তি জারির দাবিতে দেখান বিক্ষোভ৷ কিন্তু, দিনভর রাজ্যের তরফে কোনও উদ্যোগ না নেওয়ার অভিযোগ তুলে রাজপথ আগলে ধর্নায় বসে পড়েন প্রাথমিক শিক্ষকদের একাংশ৷ খোলা আকাশের নীচে রাস্তার উপর ত্রিপল পেতে বসে পড়েন শিক্ষকরা৷ আন্দোলনে গিয়ে চূড়ান্ত সমস্যায় পড়েন শিক্ষিকারও৷ সৌচালয় থেকে প্রয়োজনীয় পানীয় জল না পেয়ে সমস্যা পড়েন তাঁরা৷ তবে, প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই এই আন্দোলন চালিয়ে যেতে অনড় প্রাথমিক শিক্ষকদের একাংশ৷ এবার অনশনেও সামিল কয়েকশো শিক্ষক৷
উস্থি ইউনাইটেড প্রাইমারি টিচার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদিকা পৃথা বিশ্বাস বলেন, ‘‘আমাদের ১৪ জন সহকর্মী শিক্ষকের অনৈতিক বদলি ও আলোচনা সাপেক্ষে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য বৈষম্য দূর করতে হবে আমরা রাতভর ধর্না দিয়েছি৷ যতক্ষণ না পর্যন্ত আমাদের এই দু’টি দাবি একই সঙ্গে শিক্ষা দপ্তর মেনে নিচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা এখানেই বসে থাকবো, আমরণ অনশন করব৷ শিক্ষকদের অনুরোধ করবো, আপনারা আসুন৷ শিক্ষক ঐক্য কোন জায়গায় যেতে পারে, তা আমরা রাজ্য সরকারকে দেখিয়ে দিই৷ সরকারের পক্ষ থেকে যতদিন পর্যন্ত আমাদের দাবি মেনে নেওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা রাস্তায় থাকবো৷ আমরা আমরণ অনশন চালিয়ে যাব৷’’
শুক্রবার দুপুরে করুনাময়ী থেকে বিকাশভবন পর্যন্ত বিশাল মিছিল করেন শিক্ষকরা৷ জানান তাঁদের দাবি৷ বেতন বৃদ্ধির লিখিত প্রতিশ্রুতি ছাড়া কোনও ভাবেই কর্মসূচি তুলে নেওয়া হবে না বলে ঘোষণা উস্তি ইউনাইটেড অ্যাসোসিয়েশনের৷
রাজ্যকে দেওয়া ১৫ দিনের চূড়ান্ত সময়সীমার মধ্যে বেতন বৃদ্ধির আশ্বাস ছাড়া সরকারি কোনও সিদ্ধান্ত কার্যকর না হওয়ায় আজ রাজপথে নামেন প্রাথমিক শিক্ষকদের একাংশ৷ গত ২৪ জুন ধর্মতলা অভিযানে নেমে পুলিশি তাণ্ডবের শিকার হওয়ার পরও থামছে না যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন বৃদ্ধির দাবি৷ শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর ১৫ দিনের সময়সীমা দেওয়া হলেও তা কার্যকর না হওয়ায় আজ ফের রাজপথে নেমে রাজ্য বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ডাক দেওয়া হয়৷
প্রাথমিক শিক্ষকদের অরাজনৈতিক সংগঠন উস্তি ইউনাইটেড অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সভাপতি সন্দীপ ঘোষ ও সম্পাদক পৃথা বিশ্বাস জানিয়েছেন, ‘‘আমরা যে পে স্কেল জমা দিয়ে এসেছিলাম, শোনা যাচ্ছে রাজ্য সরকার অন্য স্কেল দিতে চাইছে৷ যেটা সাধারণ শিক্ষকরা মেনে নেবেন না৷ ১৪ জন শিক্ষককে অনৈতিক ভাবে জেলার বাইরে বদলি করা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, একদিনের মধ্যে ব্যবস্থা নেবেন৷ সেটাও এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি৷ আমরা চাই, আমাদের সংগঠন এই রাজ্যের সব প্রাথমিক শিক্ষকদের যোগ্যতা অনুযায়ী ন্যায্য বেতন নিয়ে লড়াইয়ে সামিল হয়েছেন, তাই পে রিভিউ কমিটির সঙ্গে আলোচনার জন্য আমাদের সংগঠনকে ডাকা হোক৷ অনৈতিক ভাবে বদলিপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিজের জেলায় ফেরত আনা হোক৷’’
তাঁরা আরও জানিয়েছেন, ‘‘আমরা সরকারের কাছে যে স্কেলের দাবি জানিয়েছিলাম ও শিক্ষামন্ত্রী কাগজে লিখে নিয়েছিলেন, সেই স্কেল দেওয়া হোক৷ আমরা সরকারের কাছ থেকে আগামী ১০ জুলাই দুপুর ১২টার মধ্যে এই বিষয়ে লিখিত মতামত চেয়েছিলাম৷ কিন্তু, তা না হওয়ায় আজ ফের আমরা রাস্তায় নামব৷ এবার নামব বিকাশভবনের সামনে লাগাতার অবস্থানে বসলাম৷ আশা রাখি, পশ্চিমবঙ্গের সরকার ১ লক্ষ ৮৬ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকদের আবেগ নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না৷’’