কলকাতা: দাবি ছিল দু’টি৷ প্রথমত, যোগ্যতা আনুযায়ী বেতন কাঠানোর পুনর্বিন্যাস, দ্বিতীয়ত ১৪ জন শিক্ষকের বদলির নির্দেশ প্রত্যাহার৷ টানা ১৫ দিন ধরে লাগাতার অনশন-ধর্না কর্মসূচির পর দু’টি দাবি পূরণ হতেই এবার অনশন কর্মসূচি তুলে নিলেন প্রাথমিক শিক্ষকরা৷ দীর্ঘ লড়াই, আন্দোলন, ধর্না, অনশনের পর অবশেষে জয়৷ জয়ের আনন্দে অনশন মঞ্চে উড়তে থাকে লাল আবির৷ চোখে জলে বাঁধান ভাঙে শিক্ষক বিদ্রোহের অদম্য জেদ৷ দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই শেষে অনশন মঞ্চ থেকে ওঠে, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি..’
পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির বৈঠকে নজরুল মঞ্চ থেকে শিক্ষকদের গ্রেড-পে বৃদ্ধির ঘোষণা করেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়৷ শিক্ষামন্ত্রীর ওই ঘোষণার পর আজ সরকারি ভাবে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গ্রেড-পে বৃদ্ধির ঘোষণা করে রাজ্য শিক্ষা দপ্তরের৷ বেতন বৃদ্ধির বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার পর ১৪ জন শিক্ষকের বদলির নির্দেশও তুলে নেওয়া হয়৷ জারি হয় বিজ্ঞপ্তি৷ অনশনরত শিক্ষকদের দাবি মেনে সরকারের তরফে জোড়া বিজ্ঞপ্তি জারি হতেই অনশন তুলে নেন শিক্ষকরা৷
শুক্রবার বিজ্ঞপ্তি জারি করে শিক্ষা দুপ্তরের তরফে জানানো হয়, রাজ্যপাল প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ অনুমোদন নিয়েছে৷ প্রাথমিক শিক্ষকদের গ্রেড-পে ২৬০০ টাকা থেকে পে-ব্রান্ড-টু ৩৬০০ টাকা করা হচ্ছে পে-ব্রান্ড-থ্রিতে৷ অপ্রশিক্ষিত শিক্ষকদের গ্রেড-পে ২৩০০টাকা থেকে ২৯০০টাকা করা হচ্ছে৷ আগামী পয়লা অগস্ট থেকে কার্যকর হবে৷
প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবি ছিল গ্রেড-পে অন্তত ৪২০০ করা হোক৷ কিন্তু, সেই দাবি পূরণ না হলেও ৩৬০০ টাকার গ্রেড-পে পয়লা অগস্ট থেকে কার্যকর হচ্ছে হচ্ছে৷ এর পরই ১৪ জন শিক্ষকদের বদলির নির্দেশ প্রত্যাহারের বিজ্ঞপ্তি জারি হতেই অনশন নিয়ে বৈঠকে বসেন শিক্ষকরা৷ পরে অনশন তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা৷ গত ১৫ দিন ধরে ধর্না ও ১৪ দিন অনশন চালিয়ে যাচ্ছিলেন শিক্ষকরা৷
শিক্ষক শিক্ষাকর্মী শিক্ষানুরাগী ঐক্যমঞ্চের রাজ্য সম্পাদক কিংকর অধিকারী বলেন, ‘‘এই জয় আন্দোলন ছাড়া কোনও ভাবেই সম্ভব ছিল না৷ আবার প্রমাণ হল দাবি আদায়ের একমাত্র পথ সর্বাত্মক আন্দোলন৷ আন্দোলনকারীদের সকলকে জানাই সংগ্রামী অভিনন্দন৷ ভোটের মাধ্যমে এমএলএ, এমপিরা জিতে কিন্তু আমাদেরকে লড়াই, আন্দোলন করেই দাবি আদায় করতে হয়। তাই সকল শিক্ষক শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গের কাছে আবেদন ভোটে নয়, আসুন সর্বাত্মক লড়াই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ন্যায্য দাবি আদায় করি৷ এটাই সাধারণ মানুষ হিসাবে আমাদের একমাত্র রাস্তা৷’’
মাধ্যমিক শিক্ষক শিক্ষাকর্মী শিক্ষানুরাগী ঐক্যমঞ্চের রাজ্য সম্পাদক মণ্ডলীর অন্যতম সদস্য অনিমেষ হালদার বলেন, ‘‘ভোটের মাধ্যমে নয়, দলমত-সংগঠন নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই দাবি আদায়ের একমাত্র পথ তা আবার ও প্রমাণ হল। ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষকদের এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আশা করি ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, বৈজ্ঞানিক ও সার্বজনীন শিক্ষা বাঁচানোর আন্দোলনে তাঁরা এমন ঐক্যবদ্ধভাবে পথে নামবেন। অনশনকারী-সহ সকল আন্দোলনকারীদের সংগ্রামী অভিনন্দন জানাই৷’’
বৃহস্পতিবার শিক্ষকদের গ্রেড পে বৃদ্ধির ঘোষণা করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘‘আমরা আপনাদের বেতন কাঠামো পরিবর্তন করার কথা ভাবছি৷ আমি আপনাদের গ্রেড-পে ৩২০০ টাকা সুপারিশ করেছিলাম৷ কিন্তু, ৩৬০০টাকা গ্রেড পে করা যায় কি না, তা ভেবে দেখা হচ্ছে৷ কবে থেকে চালু হবে তা আমরা জানিয়ে দেব৷ এই টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা তো আমাদের করতে হবে৷ দেখি, কোথা থেকে তা আনা যায়৷ মুখ্যমন্ত্রী চান শিক্ষকদের গ্রেড পে ৩৬০০ টাকা করা হোক৷’’ পে-স্কেল নিয়ে তৃণমূল শিক্ষক সমিতির সদস্যরা আওয়াজ তুললেও তা এড়িয়ে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী জানান, ‘‘দাঁড়ান, নির্দেশ প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন৷’’
বর্ধিত নয়, ন্যায্য বেতন! কেন্দ্রের নয়, যোগ্যতামান অনুসারে সঠিক বেতন চেয়ে টানা ১৪ দিন ধরে অনশন চলিয়ে যাচ্ছেন ১৮ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা৷ টানা ১৮ অনশন চালাতে গিয়ে এবার শিক্ষকদের শরীরে দানা বাঁধল মারণ ব্যাধি৷ কিন্তু, শরীরে মারণ ব্যাধি দানা বাঁধলেও নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকেন অনশনরত প্রাথমিক শিক্ষকরা৷
আজ বিকালে তিনি শিক্ষকদের অনশন মঞ্চে গিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন৷ বোঝার চেষ্টা করেন, কোথায় ঠিক সমস্যা৷ কেন তাঁরা এই অনশন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন৷ বেশ খানিকক্ষণ তিনি অনশন মঞ্চে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন৷ জানান, তিনি শিক্ষকদের এই আন্দোলনের পাশে থাকবেন৷ প্রয়োজনে মুখ্যমন্ত্রীকে শিক্ষকদের সমস্যার কথা জানাবেন৷
তবে, শুধু অপর্ণায় নয়, চলতি সপ্তাহে একটি ভিডিও বার্তায় সৌমিত্রবাবু অনশনকারীদের সমবেদনা জানান৷ অবিলম্বে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও চান তিনি৷ শিক্ষকদের প্রাণহানির আশঙ্কাও প্রকাশ করেন তিনি৷ গোটা বিষয়টি লজ্জাজনক বলেও মন্তব্য করেন৷ সৌমিত্রবাবুর পাশাপাশি আজ অনশন মঞ্চে গিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন সাহিত্যিক মন্দাক্রান্তা সেন৷ জানান, রাজ্য সরকার উৎসবের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করছে৷ অথচ সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের বিষয়ে উদাসীন রাজ্য৷ অবিলম্বে মুখ্যমন্ত্রীকে পাশে দাঁড়ানোর বার্তাও জানান তিনি৷ এছাড়াও সমাজের বুদ্ধিজীবী মহল থেকে বিজেপি-বাম-কংগ্রেসের নেতারাও যান অনশন মঞ্চে৷ এসএসসির অনশনকারী প্রার্থীরাও শিক্ষকদের পাশে দাঁড়ান৷ একাধিক শিক্ষক সংগঠনও প্রাথমিক শিক্ষকগদের পাশে দাঁড়িয়ে আন্দোলনে সামিল হন৷