নয়াদিল্লি: করোনা ভাইরাস নিধনে একটি কার্যকরী প্রতিষেধক তৈরির প্রতিযোগিতায় সামিল হয়েছে বিশ্বের নামী বেনামী একাধিক গবেষণাগার ও ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, তখন নতুন এবং সম্ভাবনাময় চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে উঠে আসছে আরেকটি নাম, মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি(এমএবি বা এমওএবি)র। ইতিমধ্যেই কয়েকটি বড় ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা এই অ্যান্টিবডি তৈরির কাজও শুরু করে দিয়েছে। যা বিশেষত এই নতুন ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষমতা সম্পন্ন বলেই আশা করা হচ্ছে। শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞরা এবং আমেরিকার শীর্ষ সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডঃ অ্যান্থনি ফৌসি মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি বিকাশের বিষয়টিতে সমর্থন জানিয়েছেন। বাস্তবিক অর্থে ফৌসি এই অ্যান্টিবডি গুলিকে কোভিড-১৯- এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ‘প্রায় নিশ্চিত বাজি’ বলেই উল্লেখ করেছেন।
মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডিগুলি ল্যাবে তৈরি হচ্ছে শরীরের প্রাকৃতিক অ্যান্টিবডিগুলি অনুকরণ হিসেবে যা শরীরকে রোগজীবাণু প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে। 'জামা' জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, সারস-কোভ -২ কে নিষ্ক্রিয়কারী মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডিগুলি করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ ও চিকিৎসা উভয়ের ক্ষেত্রেই সম্ভাবনাময় এবং ভ্যাকসিনের গঠন ও বিকাশের পথনির্দেশক হিসেবে সহায়তা করতে পারে। এলি লিলি অ্যান্ড কোম্পানি এবং রিজেনারেন সহ বেশ কয়েকটি ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা ইতিমধ্যে অ্যান্টিবডিগুলি পরীক্ষা করে দেখছেন যে তারা ভাইরাসে সংক্রামিত রোগীদের রোগ প্রতিরোধে এবং মারাত্মক সংক্রামণের লক্ষণগুলি প্রতিরোধে সক্ষম কিনা। কয়েক মাসের মধ্যেই একটি কার্যকারি সংকেত মিলবে বলেই আশাবাদী বিশেষজ্ঞরা।
কিন্তু কিভাবে কাজ করে এই মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডিগুলি? এগুলি আসলে লক্ষ্যভেদী অণু মা সংক্রমিত সেই নির্দিষ্ট অংশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। ভাইরাসটি ইমিউন সিস্টেমের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত রয়েছে সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেলে মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডির ক্লোন করা সেল লাইনগুলি এমনভাবে প্রস্তুতি নেয় যাতে তারা সংক্রমিত অংশটির চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে ফেলতে পারে। ওই নির্দিষ্ট অংশগুলিতে নিয়ন্ত্রিত হরমোনের সঞ্চালন কমিয়ে ভাইরাসের এককীকরণ রুখে দিতে পারে, একইসঙ্গে ভাইরাসের প্রবেশ পথটিও একাধিক দিক থেকে আটকে দিতে পারে। মনিপাল হাসপাতালের নিউমনোলোজি, ঘুমের ওষুধ ও ফুসফুসের প্রতিস্থাপন বিভাগের প্রধান ডঃ সত্যনারায়ণ উল্লেখ করেছেন যে, উনিশ শতকের শেষের দিকে নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্ত জার্মান চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানী পল এরলিচ একে ‘ম্যাজিক বুলেট’ বলে অভিহিত করেছেন।
মনোোক্লোনাল অ্যান্টিবডিগুলি বিভিন্ন অবস্থায় প্রয়োগ করা হয়, যার মধ্যে ম্যালিগন্যানসিস, অটোইমিউন রোগ এবং এমনকি কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তার ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হয়ডাঃ সত্যনারায়ণের মতে বর্তমানে ৭০ থেকে ৮০ টি মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে চিকিৎসারর জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। এই অ্যান্টিবডিগুলি সারসকোভ-২ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কিভাবে কাজ করতে পারে সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন,
ভাইরাস প্রোটিনগুলি নিষ্ক্রিয় করতে পারে।
কোষে ভাইরাসের প্রবেশপথ বন্ধ করতে পারে।
রিসেপ্টারে আটকে থেকে স্পাইক প্রোটিনগুলিকে যুক্ত হতে বাধা দেয়।
অনিয়ন্ত্রিত প্রতিরোধ প্রক্রিয়া কমিয়ে দেয়।
“আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এটি কার্যকরভাবে ভ্যাকসিনের বিকল্প হিসেবে বা ভ্যাকসিনগুলির সঙ্গে সমন্বয়মূলক কাজ করবে,” বলেও উল্লেখ করেন ডাঃ সত্যনারায়ণ।
সম্প্রতি, ন্যশনাল ইনস্টিটিউটস অফ হেলথ (এনআইএইচ) করোনার সম্ভাব্য চিকিৎসা হিসাবে মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডিগুলির জন্য দুটি ক্লিনিকাল ট্রায়াল শুরু করার কথা ঘোষণা করেছে। তালিকায় রয়েছে এলি লিলি অ্যান্ড কোম্পানির এলওয়াই-কোভি ৫৫৫ নামে একটি পরীক্ষামূলক মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি। গবেষনাধীন এই অ্যান্টিবডি করোন সংক্রমণের শুরুর দিকে ওয়াশিংটনের একজন করোনা আক্রান্তের রক্তের নমুনা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল।
অ্যাকটিভ -২ নামে একটি পরীক্ষায় ২০০ জন বহিরাগত রোগী অংশগ্রহণ করেছেন যাদের হালকা থেকে মাঝারি উপসর্গ রয়েছে এবং তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়নি। এখানে, অংশগ্রহণকারীদের অর্ধেককে এলওয়াই-কোভ ৫৫৫ প্রয়োগ করা হবে, বাকি অর্ধেক অংশগ্রহণকারীকে প্লাসবো দেওয়া হবে। এখানে সেই করোনা আক্রান্তদের সুরক্ষা এবং কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা হবে, যাদের উপসর্গ দেখা দেওয়ায়র সাত দিনের মধ্যে করোনা টেস্ট রিপোর্ট পজিটিভ দেখা গেছে এবং ১০ দিনেরও বেশি সময় ধরে উপসর্গ ছিল। এনআইএইচ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এই অ্যান্টিবডি শিরার মধ্যে প্রয়োগ করতে হয় এবং প্রায় এক ঘন্টা সময় লাগে।
ফৌসি জানিয়েছেন এর কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা হয় ৩ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে।
“পরিস্থিতি ঠিকঠাক থাকলে পরীক্ষাটির ৩য় পর্ব শুরু হবে। এক্ষেত্রে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন করোনা আক্রান্ত ৩০০ জন রোগীদের দুটি সমান ভাগ করে নতুন দুটি চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হবে।
এলি লিলির ভাইস প্রেসিডেন্ট অজয় নিরুলা জানিয়েছেন, ভ্যাকসিন না পাওয়া পর্যন্ত অ্যান্টিবডিগুলি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগকারী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সায়েন্স ম্যাগাজিনের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে এই অ্যান্টিবডিগুলি বর্তমানে করোনা প্রতিরোধক ওষুধগুলির তুলনায় বেশি কার্যকর হতে পারে – যেমন রেমডেসিভির এবং ডেক্সামেথাসন যা গুরুতর অসুস্থ করোন সংক্রমিতদের চিকিৎসায় প্রয়োগ করা হয় এবং সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ স্বাস্থ্য কর্মীদের ভাইরাস সংক্রামণের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
আর এক ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা রিজেনর'ও মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি নিয়ে কাজ করছে, এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখতে কোভিড-১৯ ককটেলটি তিনটি বৃহত আকারের, প্লাসবো নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষায় প্রয়োগ করা হয়েছে। প্রিপ্রিন্ট সার্ভারে প্রকাশিত প্রাথমিক তথ্যে বায়োআরক্সিভ দেখিয়েছে যে প্রাণীদেহে সংক্রমণে ওষুধটি চিকিৎসা ও প্রতিরোধ উভয় ক্ষেত্রেই কার্যকর ছিল।
গবেষকদের মতে, বহু ভাইরাল সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা বা পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডিগুলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যদি পরীক্ষাগুলি সফল হয় তবে বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণে একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে প্রমানিত হতে পারে।