দ্বিগুণ সুরক্ষা দেবে অক্সফোর্ডের করোনা-টিকা, পরীক্ষামূলক প্রয়োগের বড় সাফল্য

 গবেষকরা জানিয়েছেন, এই ভ্যাকসিনটি যথেষ্টই সহনশীল এবং সেই অর্থে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেনি। পার্শ্বপ্রতক্রিয়া বলতে ক্লান্তি ও মাথাব্যথার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। অন্যান্য সাধারণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলির মধ্যে দেহের যেখানে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে সেই নির্দিষ্ট স্থানে ব্যথা, পেশীর ব্যথা, ঠান্ডা লাগা এবং জ্বর জ্বর ভাব।

ওয়াশিংটন: বিশ্ব জুড়ে ভয়ঙ্কর ভাবে সংক্রমণ ঘটিয়ে চলেছে করোনা ভাইরাস। তবে এই চরম সংকটে প্রতাশ্যিতভাবেই আশার আলো দেখালো অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের আবিষ্কৃত করোনার প্রতিষেধক। এপ্রিলে প্রথম মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরুর পর থেকেই বিশ্বের ভ্যাকসিক আবিষ্কারকদের তালিকায় শীর্ষে ছিল অক্সফোর্ডের প্রতিষধক। দিনকয়েক আগেই  গবেষকরা এর কার্যকারিতা নিয়ে জোরদার দাবি করেন।

অবশেষে সোমবার মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত হল দ্বিতীয় পর্যায়ের কয়েকটি পরীক্ষা মূলক প্রয়োগের ভিত্তিতে সেই দাবির নেপথ্যে তথ্য প্রমাণগুলি। যদি ইতিমধ্যেই এর তৃতীয় পর্বের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে। প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্ট অ্যাস্ট্রাজেনেকা সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথভাবে ভাবে তৈরি সম্ভাব্য করোনভাইরাস ভ্যাকসিনটি একটি, প্রাথমিক পর্যায়ের পরীক্ষায় ইতিবাচক ব্যাপক প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করছে। গবেষকদের মতে তাদের পরীক্ষামূলক করোনা প্রতিষেধক ক্যাডক্স১ এনকোভ-১৯ (ChAdOx1 nCoV-19 – AZD1222)  করোনভাইরাস থেকে প্রাপ্ত জেনেটিক উপাদানগুলিকে একটি সংশোধিত অ্যাডেনোভাইরাস সংযুক্ত করে যা শিম্পাঞ্জিতে সংক্রমণের কারণ হিসাবে পরিচিত। প্রথম পর্যায়ের পরীক্ষায় ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়সী হাজারেরও বেশি অংশগ্রহণকারী ছিল।

গবেষকরা বলেছেন, এই ভ্যাকসিন কমপক্ষে দু-মাসের জন্য সংক্রমিতদের শরীরে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অ্যান্টিবডি এবং  টি-সেল তৈরি করে। অ্যান্টিবডির কাজ হল, কোনও ভাইরাসের সংক্রমণ হলে তার বিরুদ্ধে লড়াই করা। আর টি-সেলস বা শ্বেত রক্ত কনিকা হল এমন একটি কোষ যা টিকা প্রয়োগ করলে ওই ভাইরাসের সমস্ত বৈশিষ্ট্য শরীরে ধরে রাখে। ভবিষ্যতে কখনও ফের সেই ভাইরাসের সংস্পর্শে এলে ওই টি-সেলস ফের সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং তার বিরুদ্ধে লড়াই করে ভাইরাসকে প্রতিহত করে। টিকার মাধ্যমে তৈরি অ্যান্টিবডি শরীরে দীর্ঘ দিন না থাকলেও টি-সেলস বহু বছর ধরে শরীরে থেকে যায়। অ্যান্টিবডি নিরূপণ, যা বিজ্ঞানীরা মনে করেন ভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষা অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তা বেশ ভালোভাবেই অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সনাক্ত করা গেছে। আর অন্যান্য পরীক্ষিত প্রতিষেধকের মতই টি-সেল প্রতিক্রিয়াটি ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজের পরে আর বাড়েনি। 

অক্সফোর্ডের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু পোলার্ড একটি বিবৃতিতে বলেন, “রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি দুটি উপায় কাজ করে। রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস সনাক্ত করে এবং তাকে আক্রমণ করে। তাঁর মাধ্যমে সেগুলি হল – অ্যান্টিবডি এবং টি সেলের প্রতিক্রিয়া।” “এই ভ্যাকসিনটি উভয়কেই প্ররোচিত করার উদ্দেশ্যে, যেখানে এটি শরীরে সঞ্চালিত হওয়ার সাথে সাথে ভাইরাসটিকে আক্রমণ করতে পারে। আমরা আশা করি এর অর্থ এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসটিকে মনে রাখবে যাতে আমাদের ভ্যাকসিন মানুষকে অনেক বেশি সময় ধরে সুরক্ষা দেয়।”

গবেষকরা জানিয়েছেন, এই ভ্যাকসিনটি যথেষ্টই সহনশীল এবং সেই অর্থে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেনি। পার্শ্বপ্রতক্রিয়া বলতে ক্লান্তি ও মাথাব্যথার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। অন্যান্য সাধারণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলির মধ্যে দেহের যেখানে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে সেই নির্দিষ্ট স্থানে ব্যথা, পেশীর ব্যথা, ঠান্ডা লাগা এবং জ্বর জ্বর ভাব। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনার ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর অ্যাড্রিয়ান হিল সোমবার সিএনবিসিকে বলেন যে, প্রতিরোধের শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া মানে প্রতিষেধকের ভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যদিও কিছুই নিশ্চিত করে বলা যায় না। ব্যাক্তি বিশেষে এই প্রতিষেধকের একটি এবং দুটি ডোজ দেওয়া হচ্ছে। দুটি ক্ষেত্রেই অসাধারণ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মানব দেহে এই প্রতিষেধকের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হবে যুক্তরাষ্ট্রে।

 

গত জুনে অ্যাস্ট্রজেনিকা ও অক্সফোর্ড যৌথভাবে এই প্রতিষেধকের ২ বিলিয়ন ডোজ উৎপাদন করে বাজারে ছেড়েছে। অ্যাস্ট্রাজেনিকার সাথে যৌথভাবে প্রতিষেধক উৎপাদনকারী সংস্থা কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেসনের সিইও রিচার্ড হ্যাচেটের মতে, পরীক্ষামূলক প্রয়োগের মধ্যেই প্রস্তুতকারক সংস্থা জোর কদমে এই প্রতিষেধকের উৎপাদন প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব আরো বেশি প্রতিষেধক তৈরির চেষ্টা করছেন তাঁরা। গবেষকরা জানিয়েছেন, এই প্রতিষেধক কতটা সুরক্ষিত এবং কতটা প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে পারে তা বোঝার জন্য পরীক্ষামূলক প্রয়োগে অংশগ্রহণকারীদের কমপক্ষে অন্তত এক বছর পর্যবেক্ষণ করা হবে।  চারটি দলে বিভক্ত করা হয়েছিল অংশগ্রহণকারীদের। প্রাথমিক পর্যায়ে বয়স্ক, প্রাপ্তবয়স্ক এবং শরীরে অন্য রোগ রয়েছে এমন ব্যক্তিদের। যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে।

অক্সফোর্ডের তথ্য আশাব্যঞ্জক হলেও গবেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে প্রকৃত অর্থে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরে মানবদেহ এই প্রতিষেধক কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে সে সম্পর্কে প্রশ্ন থেকেই যায়। তাঁদের মতে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর তখনই পাওয়া যাবে যখন ভ্যাকসিনগুলি তাড়াতাড়ি তৈরি হবে এবং সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছবে। এছাড়াও গবেষকদের আরও একটি সমালোচনামূলক প্রশ্ন হ'ল কোভিড -১৯ এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে উৎপাদিত অ্যান্টিবডিগুলি পুনরায় সংক্রামিত হওয়ার বিরুদ্ধে কতটা সুরক্ষা দিতে পারবে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

sixteen − 11 =