নয়াদিল্লি: বিশ্বের ত্রাস কোভিড-১৯ ভাইরাস যখন বিশ্বজুড়ে গবেষকদের ঘুম কেড়েছে এবং এইমূহুর্তে এর উপযুক্ত প্রতিষেধক খুঁজে বের করাটাই যখন তাঁদের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন হঠাৎ করেই ম্যালেরিয়া নাশক একটি অ্যান্টিবায়োটিক হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের কার্যকারিতা নিয়ে মানুষের মনে অহেতুক এক আস্থা তৈরি হয়েছে। আর যেখানে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট এই একটিমাত্র ওষুধের ব্যবহারেই জোর দিচ্ছেন তখন বিশেষজ্ঞ মহলের সাবধান বাণীও গুরুত্ব পাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়েই এই ওষুধ প্রেসক্রাইব করার গাইডলাইনগুলি নিজেদের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে দিয়েছে আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিসেস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)।
তবে এরমধ্যেই কোভিড-১৯ ভাইরাসকে জব্দ করতে একটি শতবর্ষ পুরোনো ও বহুল প্রচলিত প্রতিষেধকের নাম উঠে এসেছে গবেষকদের গবেষণা থেকে। আর সেই প্রতিষেধক হলো যক্ষা বা টিউবারকুলোসিস-এর প্রতিষেধক ব্যাসিলাস ক্যালমেট-গুউরিন বা সংক্ষেপে বিসিজি। ফরাসি মাইক্রোবায়োলজিস্ট অ্যালবার্ট ক্যালমেট এবং ক্যামিল গুউরিনের নামানুসারে এই ভ্যাকসিনটির নামকরণ করা হয়। অত্যন্ত সংক্রামক যক্ষ্মার বা টিউবারকুলোসিসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ১৯১৯ সালে এই তৈরি করা হয়েছিল। তখন থেকে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বজুড়ে যক্ষ্মা নির্মূলে অব্যর্থ প্রতিষেধক হিসাবে এটা ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
তাঁদের মতে এই প্রতিষেধক নেওয়া থাকলে করোনার ঝুঁকি কম। কয়েকদিন আগেই বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের গবেষকরা একথা জানিয়েছন। যক্ষ্মার এই ভ্যাকসিন পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে এই প্রতিষেধক মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউনিটিকে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করতে পারে।যদিও যক্ষ্মা এবং কোভিড -১৯ সংক্রমণ দুটি খুব আলাদা রোগ – যক্ষা রোগহয় এক ধরণের ব্যাকটিরিয়া থেকে, তবে কোভিড -১৯ একধরণের ভাইরাস। ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের ইমিউনোবোলজির পরিচালক এবং হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের মেডিসিনের সহযোগী অধ্যাপক ডেনিস ফেনসম্যানের মতে বিসিজি ভ্যাকসিন টিবি ছাড়াও অন্য বহুক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে এবং “অফ-টার্গেট এফেক্টস” তৈরি করতে পারে।
করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সত্যিই এই ভ্যাকসিন কার্যকরী ভুমিকা পালন করতে পারে কিনা তা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চের (আইসিএমআর) বিজ্ঞানীরাও। এই গবেষণা সফল হলে স্বাস্থ্যসেবায় যুক্ত কর্মী ও বিশেষত বয়স্কদের প্রাণ বাঁচাতে বড় ভূমিকা নিতে পারে। যদিও আইসিএমআরের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী ডা. নিবেদিতা গুপ্তার কথায়, এই প্রতিষেধকের কার্যকারিতা সম্পর্কে সেই অর্থে এখনও কোন প্রমাণ হাতে আসেনি। মহামারীর মধ্যেই মানুষের শরীরে এর প্রয়োগ আদৌ কার্যকর হবে কিনা তারজন্য আরও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন।
আইসিএমআর এর গবেষণায় দেখা গেছে, যে দেশগুলিত যক্ষ্মা রোগের প্রতিষেধক বিসিজি দেওয়া বাধ্যতামূলক, সেই দেশগুলিতে অন্যান্য দেশের তুলনায় করোনায় মৃত্যুর হার কম। টাস্কফোর্সের এক বৈঠকে আইসিএমআরের বিজ্ঞানীদের একটি দল এই প্রতিষেধকের সম্ভাব্য ব্যবহার ও কার্যকারিতা নিয়ে আলোচনা করেছে। তবে, ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সীদের মধ্যে বিসিজির কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কোভিড-১৯ আক্রান্ত বয়স্কদের বিসিজি দেওয়া হলে সেটা তাদের শরীরের পক্ষে কতটা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। বা সমস্ত বয়স্কদের জন্যই এটি লাভজনক কিনা সেই প্রমাণ এখনও মেলেনি।
ইতিমধ্যেই বিসিজি ভ্যাকসিনের প্রয়োগ নিয়ে চিকিৎসার মাধ্যমে পরীক্ষা শুরু করে দিয়েছেন বিশ্বের অন্তত ছটি দেশের চিকিৎসকরা। এরমধ্যে ভারতও আছে। ভারতের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া জার্মানি, আমেরিকা, নেদারল্যান্ড এবং গ্রিস বড় ধরনের গবেষণা চালাচ্ছে। এমনকি বয়স্ক রোগীসহ বিভিন্ন হাসপাতালের স্বাস্থ্য পরিষেবায় যুক্ত কর্মীদেরও এর অন্তভূর্ক্ত করছে। বিশিষ্ট ওই বিজ্ঞানী বলেন, 'আমরা কোভিড-১৯ সংক্রমণে বিসিজি টিকা ব্যবহারে পর্যপ্ত প্রমাণ ছাড়া কোন সিদ্ধান্তে আসবো না যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকির সৃষ্টি করতে পারে এমন কোন পথে আমরা হাটবো না। পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পেলে তবেই তা ব্যবহারের জন্য সুপারিশ করবো৷'
নিউইয়র্ক ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির কলেজ অব অস্টিওপ্যাথিক মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. গঞ্জালো ওটাজু বলেন, 'বিসিজি নামের এই ভ্যাকসিন যে মানুষের রোগ প্রতিরোধের জন্য অনেকে ক্ষেত্রে বেশ উপকারী তার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।' মার্কিন সংবাদমাধ্যম 'টাইম'স-এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে অবস্থিত মার্ডক চিলড্রেন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এমসিআরআই) গবেষকরা দেশটির বিভিন্ন হাসপাতালের চার হাজার স্বাস্থ্যকর্মীকে নিয়ে বর্তমানে একটি গবেষণা চালাচ্ছেন। এমসিআরআই'র পরিচালক অধ্যাপক ক্যাথরিন নর্থ বলেছেন, 'ক্লিনিকাল এই ট্রায়ালটি কোভিড-১৯ এর উপসর্গের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা যথাযথভাবে পরীক্ষা করার অনুমতি দেবে। এটি আমাদের স্বাস্থ্যসেবায় যুক্ত কর্মীদের জীবন বাঁচাতে সহায়তা করতে পারে।'
গিনি-বিসাউতে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিসিজির মাধ্যমে টিকা দেয়া শিশুদের সামগ্রিক মৃত্যুহার ৫০ শতাংশ কম; শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ এবং সেপসিস কমানোর ক্ষেত্রে এই ভ্যাকসিনের যথেষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। সিএনএন এর প্রতিবেদন অনুসারে-বিসিজি ভ্যাকসিনের এই অফ-টার্গেট প্রভাবগুলির সঠিক প্রক্রিয়াটি পরিষ্কার না হলেও, ভ্যাকসিনটি অনাক্রমনতা প্রক্রিয়াটিকে নিজে থেকেই বাড়িয়ে তুলতে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাসভিলের ভ্যান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ উইলিয়াম শ্যাফনার এই ধারণাকে একটু অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন “আমি মনে করি বিসিজি ভ্যাকসিন একটি হেইল মেরি পাসের সমতুল্য,” অর্থাৎ ছোট্ট একটি সাফল্যের আশায় নেওয়া দুঃসাহসিক একটি পদক্ষেপ। তাঁর মতে এটি এমন একটি বহিরাগত ধারণা যেখানে কেউ কেউ আশার আলো দেখেছেন। তবে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে এবং দেখতে হবে।”
সূত্র-সিএনএন ও দ্য প্রিন্ট।