তৃণমূলে বিতৃষ্ণা, নাকি পদ্ম ধরার তাড়া! কেন ইস্তফা শুভেন্দুর?

কেন হঠাৎ ইস্তফা দিলেন শুভেন্দু অধিকারী?

a567c99321b8cc986b01dfeca0c308e5

 

কলকাতা: বিতর্ক, জল্পনা, হইচই। বিগত কিছু মাস ধরে রাজ্য সরকার তথা শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে ব্যাপক উন্মাদনা তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। একাধিক ইস্যুতে সাধারণ মানুষের ধারণা হয়েছিল খুব তাড়াতাড়ি হয়তো তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়তে চলেছেন শুভেন্দু। একাধিক সভা এবং বিভিন্ন ইস্যুতে বিতর্কিত মন্তব্য সেই সন্দেহকে বিশ্বাসে পরিণত করেছিল দিন দিন। অবশেষে হলও তাই। তবে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক এত তাড়াতাড়ি ছিন্ন করে দেবেন শুভেন্দু অধিকারী, সেটা হয়তো বিরোধীপক্ষের কেউও ভাবতে পারিনি। একেবারে ধাপে ধাপে তৃণমূল কংগ্রেস দল থেকে বিচ্ছেদ ঘটালেন তিনি। তবে সবই হল, কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর এখনও স্পষ্টভাবে মিলছে না। কেন হঠাৎ ইস্তফা দিলেন শুভেন্দু অধিকারী?

এইচআরবিসি-র চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর তার জায়গায় হুগলির সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে পদে নিয়োগ করা হয়েছিল। এর আগেও এই পথে থাকলেও, শুভেন্দু অধিকারীর পরে কল্যাণকে এই পদ দেওয়ার পরে বাংলার রাজনৈতিক মহলে আরো তীব্র জল্পনা সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ সম্প্রতি শুভেন্দুর বিরুদ্ধে সরাসরি সুর চড়িয়েছিলেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনকি, তাঁকে বেইমান বলতেও ছাড়েননি। দলীয় কোন্দলের ইঙ্গিত এখানেই শেষ নয়। সূত্রের খবর, প্রশান্ত কিশোর কি নিয়েও বিস্তর সমস্যা রয়েছে শুভেন্দু অধিকারীর। দলের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রশান্ত কিশোরের কমিটি নেওয়ায় তিনি বীতশ্রদ্ধ। একইসঙ্গে বিগত কয়েক মাসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব যেভাবে বেড়েছে, সেই চিত্র স্পষ্ট ফুটে ওঠার পরে শুভেন্দুকে নিয়ে জল্পনা আরও তীব্র হয়েছিল। এবার তিনি দলের মন্ত্রিত্ব পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর কার্যত ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দিয়েছে এবং রাজনৈতিক মহলের। কারণ আর কিছু মাস পরেই বিধানসভা নির্বাচন। একটু নজর দিলেই দেখা যাবে, শুভেন্দু অধিকারীর যে জেলাগুলিতে ব্যাপক প্রতিপত্তি রয়েছে, সেই জেলার ভোট শতাংশে যদি খেদ পড়ে, তাহলে তৃণমূলের পক্ষে তা অশনি সংকেত। পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর এবং মালদার কিছু অংশ শুভেন্দু অধিকারীর হাতের মুঠোয় রয়েছে বলা যায়। সে ক্ষেত্রে তিনি যদি নির্বাচনের আগেই বিজেপিতে যোগ দেন, তাহলে এই জেলাগুলিতে তৃণমূলের বিশেষ কিছু করার থাকবে না বলেই অনুমান। আর শুভেন্দু অধিকারীও হয়তো গেরুয়া শিবিরে যোগ দিয়ে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এটাই স্পষ্টতো বোঝাতে চাইছেন যে, তিনি বলেন না থাকলে সেটা তাঁদেরই বড় ক্ষতি।

বৃহস্পতিবার হুগলি রিভার ব্রিজ কমিশনার্সের চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। তারপর থেকেই কার্যত মন্ত্রিত্ব পদ থেকে পদত্যাগ করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। অবশেষে সেটাই হয়েছে। প্রথমে রাজ্য সরকারের দেওয়া নিরাপত্তা ত্যাগ, পরবর্তী ক্ষেত্রে অবশেষে মন্ত্রিসভা থেকেও পদত্যাগ। এক কথায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস দল থেকে নিজেকে কার্যত পুরোপুরি সরিয়ে নিলেন শুভেন্দু। এই পরিস্থিতিতে তার বিজেপিতে যোগদানের বিষয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে আগের থেকে অনেক বেশি মাত্রায়। ইতিমধ্যেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ মন্তব্য করেছেন, শুভেন্দু অধিকারী বিজেবিতে এলে তাঁকে সাদরে আমন্ত্রণ জানানো হবে। একইসঙ্গে কটাক্ষ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বলেছেন, “দিদিমনির ঘর ভাঙছে”। এখন একটা বিষয় সবচেয়ে বেশি কৌতুহল তৈরি করছে। আদৌ কি বিজেপিতে যোগদান করবেন শুভেন্দু অধিকারী? এই পরিস্থিতিতে এই সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি প্রবল, কিন্তু তা হলেও তৃণমূল কংগ্রেসের সদ্য প্রাক্তন এই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীকে নিয়ে এখনও স্পষ্ট ভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। তার সব চেয়ে বড় কারণ, শুভেন্দু অধিকারী এখনও পর্যন্ত পরোক্ষে তৃণমূলের বিরোধীতায় কথা বললেও, প্রত্যক্ষভাবে বিজেপির সমর্থনে বক্তব্য রাখেননি। যদিও বিগত ৬-৭ মাস ধরে প্রশাসনিক কাজে একেবারেই ‘অ্যাক্টিভ’ ছিলেন না শুভেন্দু অধিকারী। অফিসেও বিশেষ আসতেন না, বিভিন্ন জায়গায় সভা করলেও সেখানে থাকত না দলীয় পতাকা এমনকি দলের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি। তখন থেকেই তাঁর দল তাকে জল্পনা তীব্র হয়েছিল। যদিও, অধিকারী পরিবার সূত্রে খবর, একই পরিবারে অনেকগুলো পদ থাকায় সাধারণ মানুষদের কাছে ‘অনেক ঈর্ষার কারণ হয়ে উঠেছে’! ঠিক এই কারণেই শুভেন্দু অধিকারী মন্ত্রিত্ব পদ ছাড়লেন।অবশ্যই, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা এই অজুহাত মানতে একেবারেই রাজি নন।

এদিকে বিগত কয়েক সপ্তাহে শুভেন্দু বেশকিছু ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। রামনগরের সভায় তিনি দাবি করেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে তাড়াননি, তিনিও দল ছেড়ে যাননি। অন্যদিকে বাঁকুড়ার সভা থেকে পরোক্ষে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার্তা দিয়েছিলেন, দলের কে কার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে, রাতে কে কার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে, সব খবরই তিনি রাখেন। তিনি যে পরোক্ষে শুভেন্দু অধিকারীকে বার্তা দিয়েছিলেন সেটা কারো বুঝতে বাকি নেই। অতএব, কার্যত একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে শুভেন্দু অধিকারীর দূরত্ব অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। একদিকে যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গে সরাসরি কোনো মন্তব্য করছেন না তিনি, অন্যদিকে তৃণমূল সুপ্রিমোও শুভেন্দু অধিকারীর নাম নিচ্ছেন না মুখে। যদিও রামনগরের সবার পরে তৃণমূলের পক্ষ থেকে শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে বৈঠক করা হয়। সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সৌগত রায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। বৈঠকের পরে সৌগত রায় দাবি করেছিলেন, শুভেন্দুর কিছু বক্তব্য আছে, কিন্তু কোনো দাবি নেই। তিনি তৃণমূলেই আছেন এবং ভবিষ্যতে একসঙ্গে নির্বাচনে লড়বেন। যদিও এখন ব্যাপারটা স্পষ্ট হচ্ছে যে, তৃণমূলের ওই বৈঠকে আদৌ কোনো লাভ হয়নি।

আর কয়েক মাস পরেই বাংলায় বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে শুভেন্দু অধিকারীর তৃণমূলের সঙ্গে বিচ্ছেদের বড় রকমের ধাক্কা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে, তা বলাই বাহুল্য। তবে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনুমান, আরো বড় ধাক্কা অপেক্ষা করছে রাজ্যের তৃণমূল সরকারের জন্য। কারণ বাংলার রাজনীতিতে এটা সকলেই জানেন, অধিকারী পরিবার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত পারিবারিক ভাবেই নেয়। এবার শুভেন্দু অধিকারীর তৃণমূলের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর তাঁর বাবা সাংসদ শিশির অধিকারী এবং ভাই দিব্যেন্দু অধিকারি কি করেন, সেটার দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। এখন যদি নির্বাচনের আগেই শুভেন্দু বিজেপিতে যোগদান করেন তাহলে পারিবারিক বিবাদ শুরু হয়ে যাবে তখন থেকেই। কিন্তু নির্বাচনের আগে যদি এমন কোনো ঘটনা না ঘটে, তাহলে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বাংলার রাজনৈতিক জল কোন দিকে গড়ায় তা দেখার জন্য উৎসাহ কিছু কম থাকবে না। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো এই, প্রবীণ তৃণমূল নেতা এবং সংসদ শিশির অধিকারী বরাবর বলে এসেছেন তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রয়েছেন। এক্ষেত্রে শুভেন্দু অধিকারীর দিকে তাকিয়ে যদি তিনিও দল ত্যাগ করেন, তাহলে নির্বাচনের আগে হোক কী পরে, এই পরিস্থিতির সম্পূর্ণ ফায়দা তুলবে বিজেপি। যদিও তাঁর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়ে এখনও সরাসরি কোনো বক্তব্য রাখেননি শুভেন্দু অধিকারী। তবে তৃণমূলের পক্ষ থেকে সৌগত রায় জানাচ্ছেন, মন্ত্রিত্ব ছাড়লেও তৃণমূল কংগ্রেস দলেই রয়েছেন শুভেন্দু। কারণ এখনও তিনি বিধায়কের পদে রয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *