তপন মল্লিক চৌধুরী : একদিন গাস্টির্ন প্লেসে কথায় কথায় প্রেমাঙ্কুর আতর্থী বললেন, ‘‘যা অনুষ্ঠান চলছে, তার পাশাপাশি কিছু অভিনবত্ব আনাও দরকার। এই তো বাণী রয়েছে, ওই কতগুলো বৈদিক শ্লোক জোগাড় করে ফেলুক, আর গান লিখুক। রাই (রাইচাঁদ বড়াল ) সুর দিক, বীরেন শ্লোক আওড়াক, ভোরবেলায় লোকের ভালো লাগবে।”
এসব কথা যখন হচ্ছে, তার একমাস বাদে দুর্গাপুজো। বাণীকুমার ভাবতে বসে গেলেন। বীরেন ভদ্র প্রস্তাব দিলেন, যদি পুজোকে কেন্দ্র করেই কিছু করা হয় তাতে চণ্ডীপাঠ অবশ্যই থাকবে। ১৯৩২ সালে দুর্গাপুজোর মহাষষ্ঠীর সকালে ‘প্রত্যুষ প্রোগ্রাম’ শিরোনামে প্রথম সম্প্রচারিত হল একটি অনুষ্ঠান। পরের বছরও সম্প্রচারিত হয় ওই অনুষ্ঠান; নাম দেওয়া হয় ‘প্রভাতী অনুষ্ঠান’। অনুষ্ঠানটি ১৯৩৪ সালের ৮ অক্টোবর প্রথমবার মহালয়ার সকালে সম্প্রচার করা হয়। এরপর ১৯৩৬ সালে অনুষ্ঠানটির নাম হয় ‘মহিষাসুর বধ’। ১৯৩৭ সালে এই অনুষ্ঠানের নামকরণ স্থায়ী ভাবে হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ যা ১৯৩২ ও ১৯৩৩ সালে মহাষষ্ঠীর ভোরে সম্প্রচারিত হয়ে কিছু অদলবদল হয়ে অবশেষে মহালয়ার ভোরেই সম্প্রচার স্থায়ী হয়।
বাণীকুমার, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র প্রমুখের লেখা থেকে জানা যায় অনুষ্ঠানের আগের দিন রাত্রে স্টুডিয়োতেই থাকতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। অন্য শিল্পীদের রাত দু’টো নাগাদ স্টুডিয়োয় নিয়ে আসা হত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ স্টুডিওতেই স্নান সেরে গরদের ধুতি ও চাদর পরতেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে শাঁখ বেজে উঠত। শুরু হত লাইভ প্রোগ্রাম।
প্রথম দিকে কয়েক বছর রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজকুমার মল্লিক যুগ্ম সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। তবে অধিকাংশ গান পঙ্কজ মল্লিক সুরারোপিত। কিন্তু ‘বিমানে বিমানে আলোকের গানে…’ পণ্ডিত হরিশ্চন্দ্র বালী, ‘শান্তি দিলে ভরি…’ উস্তাদ সাগির খাঁ এবং ‘নিখিল আজি সকল ভোলে …’ গানে সুর করেন রাইচাঁদ বড়াল প্রমুখ। প্রসঙ্গত, ‘নিখিল আজি…’ গানটি বাদ পড়ে বহু আগেই। এ রকম অনেক গান ছিল যা পরে মহিষাসুরমর্দিনী থেকে বাদ পড়ে। একটি দুটি গান বিকল্প বা পরিবর্তীত হিসেবেও ভাষ্যে উল্লেখ করেছেন বাণীকুমার, যে গান বহু বছর আগে থেকেই শোনা যায় না। সংস্কৃত স্তোত্রও অনেক বাদ গিয়েছে।
সময়ের কথা মাথায় রেখেই এগুলো করতে হয়েছে। প্রথম দিকে এক ঘণ্টা, কোনও কোনও বছর দু’ঘণ্টা, পরবর্তীতে অনুষ্ঠানটি মোটামুটি দেড় ঘণ্টায় স্থায়ী হয়। ১৯৭২ সালে স্থায়ীভাবে রেকর্ড হওয়ার আগে পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানের অজস্র পরিবর্তন ঘটেছে।
সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে বেতার কর্তৃপক্ষের কোনও কারণে মতবিরোধ হওয়ায় ১৯৪৪ ও ১৯৪৫ বছর দু’টিতে তাঁর জায়গায় গানের সুর এক রেখে গোটা অনুষ্ঠানটির সঙ্গীত পরিচালনার কাজ সামলেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ১৯৪৫ সালে অন্য গানসহ সম্পূর্ণ নতুন একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়। তাতে যৌথ সঙ্গীতপরিচালক ছিলেন বিজনবালা ঘোষদস্তিদার ও শচীন দাশ মতিলাল। কিন্তু সেটি শ্রোতাদের একেবারেই পছন্দ হয় না। অবশেষে ১৯৪৬ সালে একইসঙ্গে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ ও পঙ্কজকুমার মল্লিক-এর প্রত্যাবর্তন ঘটে। সে বছর অবশ্য লাইভ না হয়ে রেকর্ডেড সম্প্রচার করতে হয়। কারণ সে বছর ১৬ অগস্ট থেকে কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়েছিল তাতে অত রাতে শিল্পীদের আনার ঝুঁকি কর্তৃপক্ষ নেননি।
এই অনুষ্ঠানের আদিযুগে গান গাইতেন কৃষ্ণ ঘোষ, আভাবতী, প্রফুল্লবালা, বীণাপানি, প্রভাবতী প্রমুখ। পঙ্কজ মল্লিক ছাড়া এঁদের কারওরই কণ্ঠ পরে আর শোনা যায়নি। ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকা থেকে জানা যায়, ১৯৪০-এ গাইতেন পঙ্কজ মল্লিক, অনিল দাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শৈলদেবী, ইলা ঘোষ, সুপ্রভা ঘোষ (সরকার), কল্পনা হাজরা প্রমুখ।
এমনকী এই অনুষ্ঠানে গেয়েছেন জগন্ময় মিত্র, রাধারানী দেবী, সাবিত্রী ঘোষ, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পান্নালাল ভট্টাচার্য, শচীন গুন্ত, বাঁশরী লাহিড়ি, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, কল্যাণী মজুমদার, অখিলবন্ধু ঘোষ প্রমুখ। এঁদের গানও পরবর্তীতে আর শোনা যায় নি। জানা যায়, শৈল দেবী গাইতেন, ‘বিমানে বিমানে আলোকের গানে…’, ‘বাজল তোমার আলোর বেণু…’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ১৯৪০ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানে গাইতেন, ‘জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী…’
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া, ‘তব অচিন্ত্য …’ গানটিও প্রথম দিকে ছিল না। অন্যদিকে কৃষ্ণচন্দ্র দে, যূথিকা রায়, শচীন দেব বর্মন, কানন দেবী, কে এল সায়গল, সুধীরলাল চক্রবর্তী, রবীন মজুমদার, মান্না দে’র মতো বিখ্যাত শিল্পীরা কোনও দিনই এই অনুষ্ঠানে গান করেননি। ১৯৭৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, মহালয়ার ভোরবেলা আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে বেজে উঠল চিরাচরিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র বদলে ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’৷ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের আশ্বিনের শারদ প্রাতের বদলে মহানায়ক উত্তমকুমার বসন্ত চৌধুরী, পার্থ ঘোষ, ছন্দা সেন, মাধুরী মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, প্রমুখের ভাষ্যপাঠ।
বাণীকুমারের আলেখ্যর পরিবর্তে ধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তীর স্ক্রিপ্ট। গান লিখেছিলেন শ্যামল গুপ্ত। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে গান গেয়েছিলেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, বনশ্রী সেনগুপ্ত, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, অসীমা ভট্টাচার্য, অনুপ ঘোষাল, অপর্ণা সেনগুপ্ত, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং লতা মঙ্গেশকর ও আশা ভোঁসলে। প্রথম বারের জন্য সেই ঐতিহ্য ছিন্ন হল কিন্তু শ্রোতাদের প্রবল আপত্তিতে কর্তৃপক্ষ ফের মহিষাসুরমর্দিনী বাজাতে বাধ্য হন।