বিবস্বান বসু: সেই ট্র্যাডিশন সমানেই চলিতেছে৷
একুশের বিধানসভার যুদ্ধ বাংলার মাটিতে ‘আসল পরিবর্তন’ ঘটাবে কি না, তার জন্য অপেক্ষা এখনও দিন কুড়ির৷ তবে বাংলার ভোটে রক্তক্ষয়ী হিংসার প্রত্যাবর্তন ইতিমধ্যেই ঘটে গিয়েছে পরম্পরা মেনে৷ প্রথম তিন দফার ভোটে বিক্ষিপ্ত অশান্তি-সংঘর্ষ-সন্ত্রাস বা প্রার্থীর আক্রান্ত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটলেও, দেখা মেলেনি বড় ধরনের কোনও হিংসার ছবির৷ তৃণমূল-বিজেপি কর্মীর খুন বা দেহ উদ্ধারের অভিযোগ সামনে এসেছে বটে, কিন্তু সার্বিক প্রেক্ষাপটে তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই থেকে গিয়েছে৷ ভোট-চতুর্থীর সকাল অবশ্য দেখিয়ে দিল, বাংলা আছে বাংলাতেই৷ পঞ্চায়েত হোক বা পুরসভা, লোকসভা হোক বা বিধানসভা, এরাজ্যের বুকে নির্বাচন যে গণতন্ত্রের উৎসব নয়, বরং রক্তের হোরিখেলা, তা প্রমাণ হয়ে গেল আরও একবার৷
রক্তপাতহীন ভোট করানোই যেখানে ছিল নির্বাচন কমিশনের চ্যালেঞ্জ, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের স্বার্থে যেখানে আট দফার রাজসূয় যজ্ঞ, সেখানে রক্তক্ষয়ী হিংসার চেনা ছবি ফিরিয়ে চতুর্থ দফার লড়াইয়ে ঝরে গেল পাঁচ-পাঁচটি তরতাজা প্রাণ৷ যুযুধান রাজনৈতিক শিবিরের কাদা ছোড়াছুড়ি, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নিয়ে পারস্পরিক তরজা, ‘উসকানি’ বনাম ‘ষড়যন্ত্র’ তত্ত্বের কাটা-ছেঁড়া, সবই চলবে প্রত্যাশিত পথে, কিন্তু যেমন খালি হয়ে গেল পাঁচ মায়ের কোল, তেমনই মিলবে না শুধু প্রশ্নের উত্তর- এই হিংসার দায় কার? এই মৃত্যুর দায় কার? শীতলকুচির মাটিতে রক্তের হিমেল স্রোত বয়ে যাওয়ার দায় কার? এই রক্তাক্ত গণতন্ত্রের দায় কার?
চতুর্থ দফায় যে পাঁচ জেলায় ভোট ছিল, তার মধ্যে হাওড়া, হুগলি আর দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ইতিমধ্যে চাকা গড়ালেও, কোচবিহার আর আলিপুরদুয়ারে এদিনই ছিল প্রথম ভোট৷ ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনকে মাপকাঠি ধরলে, বিজেপির ব্যাপক শক্তিবৃদ্ধির ফলে উত্তরবঙ্গ এখন তৃণমূলের কাছে রীতিমত কঠিন ঠাঁই৷ তাই লড়াইটা যে কাঁটে কা টক্কর, তা স্পষ্ট হতে শুরু করেছিল ভোটপ্রচার থেকেই৷ কোচবিহারের যে জনপদে শনিবার চিরতরে থেমে গেল পাঁচ জনের হৃৎস্পন্দন, সেই শীতলকুচি ক’দিন আগেই তপ্ত হয়েছিল বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের কনভয়ের ওপর আক্রমণে৷ সেদিক থেকে দেখতে গেলে, আগুনটা ধিকিধিকি জ্বলছিলই৷ ভোটের লাইনে প্রথমবারের জন্য দাঁড়িয়েই তরুণের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু বা তার অব্যবহিত পরেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর (সিআইএসএফ) জওয়ানদের গুলিতে চার জনের প্রাণহানি সম্ভবত সেই আগুনেরই লেলিহান রূপ৷ কিন্তু প্রশ্নটা আবার ঘুরে-ফিরে একই- এই আগুন লাগানোর দায় কার? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাকি অমিত শাহের? নাকি গোটা রাজনীতিক সমাজেরই, যাঁরা জনগণকে ব্যবহার করেন দাবার বোড়ে হিসেবে, যাঁরা বারবারই প্রমাণ করেন, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়?
শনিবাসরীয় ভোটযুদ্ধের ময়নাতদন্ত বলছে, বিজেপি-তৃণমূলের রাজনৈতিক হানাহানির ফলেই শেষ হয়ে গিয়েছে প্রথম ভোট দিতে আসা তরুণের জীবন৷ কিন্তু দিনের শেষে সেটা ছাপিয়ে শিরোনামে উঠে এসেছে বাহিনীর বুলেট৷ কমিশনে জমা পড়া রিপোর্ট বা সিআরপিএফের বিবৃতি অনুযায়ী, আক্রমণাত্মক জনতাকে রুখতে, আত্মরক্ষার স্বার্থে গুলি চালাতে হয়েছে বাহিনীকে৷ রাজনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই সেই তত্ত্ব উড়িয়ে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছেন, এর নেপথ্যে শাহি ষড়যন্ত্র৷ উলটো দিকে, তৃণমূল নেত্রীর ‘সিআরপিএফ ঘেরাও’য়ের নিদানকে দুষে নরেন্দ্র মোদির দাবি, উসকানিরই ফল এই দুঃখজনক ঘটনা। এটা বোঝার জন্য রাজনৈতিক বিশ্লেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই যে, বাকি চার দফায় আরও চড়বে এই ‘ষড়যন্ত্র’ বনাম ‘উসকানি’র পারদ। দল-নির্বিশেষে রচিত হবে মৃত্যু নিয়ে রাজনীতির নয়া চিত্রনাট্য।
তৃণমূল নেত্রী যেমন এই প্রাণহানিকে হাতিয়ার করে বাহিনীকে আরও কাঠগড়ায় তুলে ভোট-রাজনীতির ফায়দা তোলার চেষ্টা করবেন পূর্ণমাত্রায়, শীতলকুচির মাটি থেকেই তুলতে চাইবেন সহানুভূতির ঝড়, তেমন বিরোধী বিজেপিও আরও জোর গলায় প্রমাণ করতে চাইবে, হার নিশ্চিত বুঝেই অশান্তিতে প্ররোচনা দিচ্ছেন মমতা, বাহিনীকে বাধ্য করছেন গুলি চালাতে। জনতার হামলার অভিযোগ নস্যাৎ করে তৃণমূল যেমন প্রশ্ন তুলবে, কেন চলল না লাঠি-কাঁদানে গ্যাস, কেন আত্মরক্ষার জন্য পায়ে না-করে গুলির টার্গেট হয়ে উঠল বুক, কেন মিলল না অশান্তির ভিডিও ফুটেজ, তেমনই রাজ্যের শাসক দলের পালের হাওয়া কেড়ে নিতে বিজেপিও প্রশ্ন তুলবে, কেন এমন পরিস্থিতি তৈরির উসকানি দেওয়া হল, যার জন্য গুলি চালানো ছাড়া উপায় রইল না জওয়ানদের।
প্রশ্ন যেমন উঠবে জনতার মোকাবিলায় বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে, তেমন উঠবে কমিশনের ভূমিকা নিয়েও। প্রশ্ন উঠবে, আট দফায় নির্বাচন করিয়েও অশান্তি রুখতে সফল-সক্রিয় পদক্ষেপ করতে পারছে তো কমিশন? তার চেয়েও জোরালো হয়ে উঠবে যে প্রশ্ন, এই দোষারোপের শেষ কোথায়? শুধুমাত্র কুর্সি দখলের জন্য আমজনতার প্রাণ নিয়ে এই ছিনিমিনি খেলার শেষ কোথায়? কেন এড়ানো যাচ্ছে না রক্তপাত? যুযুধান রাজনৈতিক দলই হোক বা কমিশন- মানুষের অমূল্য জীবন নিয়ে এই উদাসীনতার শেষ কোথায়? অভাব কি শুধুই সদিচ্ছার? বাংলার ভোটেরও বোধ হয় এবার প্রশ্ন তোলার সময় হয়েছে, কতটা রক্ত ঝরলে পরে শান্তি পাওয়া যায়?