করোনার থেকেও দ্রুত ছড়াচ্ছে স্কুলছুটের সংক্রমণ! লঙ্ঘিত শিক্ষার অধিকার?

করোনার থেকেও দ্রুত ছড়াচ্ছে স্কুলছুটের সংক্রমণ! লঙ্ঘিত শিক্ষার অধিকার?

কলকাতা: শিক্ষা একজন মানুষকে প্রকৃত ‘মানুষ’ করে তোলে। শিক্ষার অধিকার সকলের। কিন্তু ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে শিক্ষা তো দূরে থাক, স্বাক্ষরতার হার ৬৭%। এখানে মানুষের কাছে বিজ্ঞান নেই, ফলত গেঁথে বসেছে কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাস। এখনও সাপে কামড়ালে গ্রামের মানুষ হাসপাতালের বদলে ওঝার কাছে দৌড়ান। 

২০২১ সালে দাঁড়িয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশে তথ্য প্রবাহের অসাম্যতা তীব্র ভাবে চোখে পড়ে। শিক্ষার অধিকার আইনে ৬-১৪ বছরের শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা থাকলেও তার বাস্তবায়নে অভাব রয়েছে৷  তবুও নিতান্ত বাধ্য হয়েই যেসব ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেত, লকডাউনে তাদের পড়াশুনো উঠেছে শিকেয়। আবার গ্রামের দিকে যেসব পড়ুয়ারা শুধুমাত্র আঞ্চলিক ভাষাকে প্রথম ভাষা হিসাবে সরকারি স্কুলে পড়াশুনো শুরু করে, তাদেরও ক্লাস বন্ধ প্রায় দশ মাস। অবশ্য সারা পৃথিবী জুড়ে এখন ওয়ার্ক ফর্ম হোম আর অনলাইন এডুকেশন সিস্টেমের প্রচার চলছে। কিন্তু এই অনলাইন এডুকেশন এবং অনলাইন কাজ কর্ম দেশের কতজন মানুষ  সাবলীল ভাবে ব্যবহার করতে পারবেন, বা কতজন প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার এবং সেগুলোর মাসে মাসের খরচা বহন করতে পারবেন এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

বাস্তব চিত্রটা খুব করুন। ১২১ কোটির দেশে চালচুলোহীন শিশু ছাড়া একটাও ফুটপাথ চোখে পড়ে না। ইঁটভাটা বা রাস্তার ধারের দোকানে ছোটছোট ছেলে মেয়েদের কাজ করতে হামেশাই দেখা যায়। অবশ্য কাজ না করলে এদের পেটে ভাত জুটবে না। কেননা খাদ্যের অধিকার আইন থাকলেও তারও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি এতদিনে। অবশ্য এখন স্কুলে ভর্তির জন্য আধার কার্ড আবশ্যিক করা হয়েছে। গ্রামের বহুমানুষ ছেলে মেয়েদের বয়স আঠারো না হলে বার্থ সার্টিফিকেটকেই প্রমাণপত্র হিসাবে রাখেন। আঠারো বছর হলে এমনিই কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের তরফে ভোটার কার্ডের আবেদন জমা পড়ে যায়। তাই আধার কার্ড না থাকায় বহু শিশুরা স্কুলে ভর্তি হওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলেও উঠছে অভিযোগ। 

গ্রামাঞ্চলে যেসব পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ, সেই সব পরিবারের মধ্যেও কিছুকিছু পরিবার চায় তাদের সন্তান শিক্ষিত হোক। তাঁরা কিছুটা জোর করেই ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠান। আবার কেউ কেউ শুধু মাত্র মিডডে মিলের জন্যই স্কুলে আসে। গ্রামের স্কুলের শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কিছুকিছু ছেলে মেয়েদের বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে কিছু পড়ুয়া রাতের খাবারের জন্য দু’হাতা ভাত বেশি নিয়ে রাখে টিফিন বক্সে। এই সব পড়ুয়ারা স্কুলে এসে শিক্ষকদের সান্নিধ্য পেত। কখনও কখনও শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের আলাদা আলাদা করে সময় দিয়ে কথা বলে বা বুঝিয়ে অন্তত কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাস কাটিয়ে ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞান মনষ্ক করে তোলেন। শিক্ষকদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাও নেই ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষায় খুব ভালো ফল করবে বা সরকারি চাকরি পাবে। তাঁরা চান ছেলেমেয়েগুলো কিছুতে সই করার আগে যেন নিজে পড়ে বুঝে সই করতে পারে কিংবা অসুখ হলে বদ্যির কাছে না গিয়ে যেন দ্রুত হাসপাতালে যায়। 

কিন্তু যে পরিকাঠামোয় এতদিন শিক্ষকরা ছেলে মেয়েদের কাছে পৌঁছেছেন, তার মাঝখানে এখন যোজন যোজন দূরত্ব তৈরি হয়েছে। গ্রামের দিকে বেশির ভাগ অঞ্চলেই মোবাইল নেটওয়ার্ক থাকে না। অর্ধেক ছেলেমেয়ে এখনও মোবাইলকে একটা বড়লোকি চালের বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে দেখে। সেই মাধ্যমে যখন তাদের পড়াশুনো করতে হচ্ছে তা পুরোটাই সোনার পাথর বাটির মতো। কখনও শিক্ষকরা কিছু বলছেন তা ছাত্রছাত্রীরা শুনতে পান না, কখনও বা ছাত্রছাত্রীদের কথা স্পষ্ট শোনা যায় না। দেখা যায় না ব্ল্যাকবোর্ড বা বইয়ের লাইন। তাছাড়া মাসে মাসে দুশো টাকা খরচা করে নেট রিচার্জ করার সামর্থ্য বহু পরিবারের নেই। 

সমস্যা মূলত গোড়াতেই। কেননা শিক্ষা ব্যবসায় যত শিক্ষার চাহিদা বাড়বে, শিক্ষা এবং তার সামগ্রীর দাম ও বিক্রি তত বাড়বে। আগে যেমন স্কুলে পড়তে গেলে একটা স্কুল ব্যাগ, বই খাতা আর পেন আবশ্যিক ছিল, এখন তেমন ফোন, ট্যাব বা ল্যাপটপ, মাসে মাসে নেট বা ওয়াইফাই বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এখন গ্রামাঞ্চলে যাদের দিন আনা দিন খাওয়া সংসার চলে তাদের কজনের পক্ষে নতুন এই শিক্ষা ব্যবস্থার খরচ বহন করার ক্ষমতা আছে? ক’জন মানুষ সামনাসামনি কথোপোকথনের বদলে স্ক্রিনের সামনে অস্পষ্ট ভাবে শুনে দেখে পড়াশুনো চালিয়ে যেতে চায়? 

শিক্ষাবর্ষ ক্রমেই এগিয়ে চলেছে। ঘোষণা হয়েছে উচ্চমাধ্যমিক এবং সিবিএসসি বোর্ডের পরীক্ষার দিন। এরমধ্যে যারা এখন টুয়েলভে পড়ে অর্থাৎ যারা গতবছর লকডাউনে যারা ইলেভেনে পড়াকালীন টুয়েলভে উত্তীর্ণ হয়েছিল, তাদের কেউই এখনও পর্যন্ত একটাও প্র্যাক্টিকাল ক্লাস করেনি। যদি না স্কুল খোলে তবে কোনও রকম প্র্যাক্টিকাল না করেই পড়ুয়াদের কলেজে গ্রাজুয়েশনের ক্লাস করতে হবে। সেক্ষেত্রে সায়েন্সে পড়ুয়াদের তীব্র অসুবিধার মুখে পড়তে হবে। 

চাপ কমানোর জন্য ছেঁটে ফেলা হল সিলেবাস। কিন্তু যে সব চ্যাপটার ছেঁটে ফেলা হল তা কতটা হিতকারী ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে? নম্বরের ঝুলি নিয়ে ইঁদুর দৌড় শুরু হয়েছে বহুদিন। সেই নম্বরের প্রতিযোগীতায় টিকে থাকতে পড়ুয়াদের সিলেবাস কমিয়ে ফেলা হল নিজেদের ব্যর্ততা ঢাকতে। অথচ ছাত্রছাত্রীদের অজানা থেকে গেল বহু বিষয়। রাজ্যে কবে স্কুল শুরু হবে তা নিয়ে বিশেষ কিছু জানা যায়নি। কিন্তু এটা শুধু রাজ্যের কথা না দেশের প্রতিটা গ্রামাঞ্চলে একই ছবি। ছাত্রছাত্রী সাপেক্ষে শিক্ষকের সংখ্যা কম থাকলেও, শিক্ষকদের চেষ্টায় বহু ছেলেমেয়ে স্কুল ছুট না হয়ে স্কুল ইউনিফর্মটা সপ্তাহে দু’দিন হলেও পড়ে। কিন্তু লকডাউনে বহু ছেলেমেয়ে স্কুল ছুট হয়েছে বোঝা যায় নাইন থেকে যারা টেনে উঠল তাদের কজন ফর্ম ফিলাপ করল। সারা দেশে স্কুল ছুটের সংখ্যাটা প্রচুর। এই বিচিত্র দেশে সব কিছুর অধিকার আছে। কিন্তু কোনও অধিকার কেউ ভোগ করতে পারে না। শিক্ষার অধিকার আমাদের সবার। কিন্তু সে শুধু মাত্র সংবিধান আর দফতরের ফাইলেই বন্ধ হয়ে পড়ে আছে, বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

one × two =