ভোটের আগে ফের সক্রিয় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা, তা কি স্রেফ রাজনীতি?

ভোটের আগে ফের সক্রিয় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা, তা কি স্রেফ রাজনীতি?

তপন মল্লিক চৌধুরী :  বছর চারেক আগে এ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের আগে নারদকাণ্ডে তোলপাড় হয়েছিল রাজ্য রাজনীতি। সূত্র ছিল নারদ নিউজ়ের কর্ণধার ম্যাথু স্যামুয়েলের স্টিং অপারেশনের ভিডিও। ওই ফুটেজেতৃণমূলের একাধিক নেতা-মন্ত্রীকে টাকা নিতে দেখা যায়। সিবিআই ও ইডি ওই তদন্তভার নেয়।ইডিমদন মিত্র, মুকুল রায়, সৌগত রায়, সুলতান আহমেদ, ইকবাল আহমেদ, কাকলি ঘোষ, প্রসূন বন্দ্য়োপাধ্য়ায়, শুভেন্দু অধিকারী, শোভন চট্টোপাধ্য়ায়, সুব্রত মুখোপাধ্য়ায়, ফিরহাদ হাকিম, অপরূপা পোদ্দার ও আইপিএস সৈয়দ হুসেন মির্জার নামে আর্থিক তছরুপের মামলা করে। অভিযুক্তদের মধ্যে মুকুল রায় এবং শোভন চট্টোপাধ্যায় এখন বিজেপিতে,আইপিএস মির্জা সাসপেন্ড, সুলতান আহমেদ মারা গিয়েছেন, শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে সম্প্রতি তৃণমূলেরদূরত্ব বেড়েছে, মদন মিত্র প্রায় নিস্ক্রিয়, অপরূপা পোদ্দারও দলের সাইডলাইনে, তবে ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং সৌগত রায় পুরোপুরি সক্রিয়।

ক’দিন আগে মুকুল রায়কে ইডি নোটিস পাঠিয়েছিল বলে খবর, যদিও মুকুলের দাবি তিনি কোনও চিঠি পাননি। রাজ্যের বিধানসভা ভোটের আগে ইডিরাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, হাওড়ার সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্রকেনারদ কাণ্ডে আয়-ব্যয়ের হিসাব চেয়ে নোটিশ পাঠিয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তাঁদের ২০১৩ থেকে ২০২০ পর্যন্ত আয়–ব্যয়ের বিস্তারিত হিসেব ইডির কাছে জমা দিতে হবে। কেবল নারদা নয়,ইডি রোজভ্যালির প্রায় ৬ কোটি টাকার গাড়ি বাজেয়াপ্ত করার অনুমতি চেয়ে বিশেষ আদালতে আবেদনও জানিয়েছে।

এ রাজ্যে দীর্ঘ বাম জমানার অবসানের মাত্র ২ বছরের মধ্যে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক নেতা-মন্ত্রীর বিরুদ্ধে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়েছিল চিটফান্ড কেলেঙ্কারির অভিযোগ। বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তারও হন। যদিও কেন্দ্রীয় সংস্থারসারদা, রোজভ্যালি কাণ্ডের তদন্ত ও মামলা ছ’বছর পরও সেভাবে এগোয়নি।বরং তৃণমূল বারবার কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার অভিযোগ তুলেছে, অন্যদিকেবিরোধী বাম ও কংগ্রেস সামনে এনেছে তৃণমূল-বিজেপি সেটিং তত্ত্ব।সামনে আরও একটা বিধানসভা নির্বাচন। ফের ইডির নোটিশ। তবে কি রাজ্য দখলে মরিয়া বিজেপি এবারও বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অস্ত্র হিসেবে চিটফান্ড কেলেঙ্কারিকে কাজে লাগাতে চাইছে?

ক্ষমতায় আসার পর থেকেইমোদি-শাহ বিরোধী দল ও নেতাদের শায়েস্তা করতেকেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ। উদাহরণ হিসাবে একে একে উল্লেখ করা যায় হিমাচল প্রদেশের কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী বীরভদ্র সিংয়ের মেয়ের বিয়ের সময় সিবিআই-এর তল্লাশি অভিযান,গুজরাট রাজ্যসভানির্বাচনের ঠিক আগেই কংগ্রেস পরিষদীয় দলে ভাঙন ঠেকাতে বিধায়কদের নিজের রিসর্টে ঠাঁই দেওয়া, কর্নাটকের মন্ত্রী শিবকুমারের ঠিকানায় আয়কর হানা বা সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশের কয়েকজন বিজেপি বিধায়ক কংগ্রেসের দিকে যাছেন; এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথের ভাইপোকে ইডি গ্রেপ্তার করে। বিরোধীদের চাপে রাখা কিংবা প্রতিহিংসার রাজনীতির ঘটনা এখানেই থেমে নেই।সনিয়া ও রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে নতুন করে আইনি তৎপরতাযাতে প্রয়োগ করা যায়, তার জন্য ইডি’র ডিরেক্টর বদল করে ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলার বন্ধ ফাইল নতুন করে খোলা হয়। প্রিয়াঙ্কা গান্ধী সক্রিয় রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে ওঠার পরেই তাঁর স্বামীকে জেরার জন্য দফায় দফায় তলব করা হয়।কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে কাজে লাগিয়ে কেন্দ্র তথা বিজেপির এ ধরণের প্রতিহিংসাপ্রবণ রাজনীতি কেবলমাত্র কংগ্রেসের বিরুদ্ধেই নয়, বিজেপি বিরোধী অখিলেশ যাদব, মিসা ভারতী, দয়ানিধি মারানের মতো নেতাদের বিরুদ্ধেও ঘটিয়েছেন।

সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রতিহিংসার রাজনীতির কোনও স্থান নেই বললেও সাম্প্রতিক ঘটনাবলী দেখিয়ে দেয়কিভাবে কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল তাদের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে এক বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করে বিরোধীদের শায়েস্তা করে, দমন করে। একেবারে হালেও দেখা গিয়েছে-অন্ধ্রপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুদলীয় বিক্ষোভ-কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার আগেই জগনমোহন সরকার তাঁকে বিশেষ কৌশলে গৃহবন্দি করে। তামিলনাড়ু রাজ্যের দুই প্রধান আঞ্চলিক দলের রাজনৈতিক বিরোধ ব্যক্তিগত পর্যায়ে এমন শত্রুতায় পর্যবশিত হয়েছিল যার দরুন একের পর এক প্রতিহিংসার ঘটনা ঘটেছিল, সেসব অবশ্য এখন ইতিহাস। করুণানিধি এবং জলললিতা এই দুজনের যে যখনই ক্ষমতা দখল করেছেন তখন প্রতিহিংসায় অন্যেরবিরুদ্ধে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছেন। মাঝরাতে পুলিশ বৃদ্ধ করুণানিধিকে ঘুম থেকে তুলে টেনে-হিঁচড়ে প্রিজন ভ্যানে তুলেছে। আসলে ওই দলগুলির মধ্যে ক্ষমতা দখল ছাড়া কোনও রাজনীতি নেই।

কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি গত ছ’বছর ধরে তদন্ত বা মামলা চালিয়েও চিটফান্ড কেলেঙ্কারি কান্ডের কোনও কুলকিনারা করতে পারেনি। শুধু বিরোধীরা আওয়াজ তুললে কিংবা ভোট এগিয়ে এলেই তাদের সক্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে যে তার ব্যতিক্রম ঘটবে ইতিহাস সে কথা বলে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *