সমস্যা এড়াতে পড়ুন ‘নাগরিক আইনে’র জরুরি তথ্য, কাজে আসবে!

দেশজুড়ে বিরোধিতার মধ্যেই ১২ ডিসেম্বর,২০১৯ আইনে পরিণত হয়েছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল৷ তারপর থেকে সেই বিরোধিতা একের পর এক আন্দোলনের রূপ নিয়েছে৷ দেশের বিরোধী দল যখন বলছে এই আইন নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার আইন, তখন দেশের শাসকদলের জোরালো দাবি এই আইন নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য৷ এসবের মধ্যেই আবার নাগরিক পঞ্জি নিয়ে নতুন করে শাসক-বিরোধি তরজা শুরু৷ জনসাধারণকে আশ্বস্ত করতে দুপক্ষই যখন নিজের মত করে যুক্তি দিয়ে চলেছেন তখন এই সাধারণ মানুষের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে নানান প্রশ্ন৷ 

নয়াদিল্লি: দেশজুড়ে বিরোধিতার মধ্যেই ১২ ডিসেম্বর,২০১৯ আইনে পরিণত হয়েছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল৷ তারপর থেকে সেই বিরোধিতা একের পর এক আন্দোলনের রূপ নিয়েছে৷ দেশের বিরোধী দল যখন বলছে এই আইন নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার আইন, তখন দেশের শাসকদলের জোরালো দাবি এই আইন নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য৷ এসবের মধ্যেই আবার নাগরিক পঞ্জি নিয়ে নতুন করে শাসক-বিরোধি তরজা শুরু৷ জনসাধারণকে আশ্বস্ত করতে দুপক্ষই যখন নিজের মত করে যুক্তি দিয়ে চলেছেন তখন এই সাধারণ মানুষের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে নানান প্রশ্ন৷   

একনজরে নাগরিক ও অধিবাসী সম্পর্কিত কিছু তথ্য৷

এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন) – নাগরিকদের জাতীয় নিবন্ধ
সিএএ (সিটিজেন অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট) – নাগরিক সংশোধনী আইন
এনপিআর (ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার) – জাতীয় জনসংখ্যা নিবন্ধক

 

অধিবাসী ও নাগরিকের মধ্যে পার্থক্য কী?  অধিবাসী অর্থাৎ রেসিডেন্ট শব্দের অর্থ হল বসবাসকারী৷ একটি অঞ্চল বা দেশে যারা কিছু সময় ধরে বসবাস করেন, তারাই সেই সময়ে সেই অঞ্চল বা দেশের অধিবাসী৷ আবার নাগরিক(সিটিজেন) হলেন তারাই, যারা সেই দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হন৷ সুতরাং একটি দেশে যাদের ভোটদানের অধিকার আছে তারাই নাগরিক৷ উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পড়াশোনা বা কাজের সূত্রে কয়েক বছর ধরে ভারতে আছেন৷ তিনি অবশ্যই ভারতের অধিবাসী, কিন্তু নাগরিক নন৷ কারণ, এদেশে ভোটদানের অধিকার তার নেই৷ আবার অন্যদিকে, একজন ভারতীয় ভোটার যদি কাজের সূত্রে কয়েকবছর বিদেশে থাকেন তার কিন্তু ভোটদানের অধিকার চলে যায় না৷ তাই তিনি ভারতীয় নাগরিক৷

ভারতের নাগরিকত্ব কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়? ভারতের নাগরিকত্বের বিষয়টি সাংবিধানিক নির্দেশ ও নাগরিকত্ব আইন দ্বারাই নির্ধারিত হয়৷২৬ জানুয়ারি, ১৯৫০ ভারতের সংবিধান প্রণয়ন হওয়ার দিনই নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় কারা ভারতীয় নাগরিক৷ ভারতীয় সংবিধানের ২য় অধ্যায়ের ৫ম থেকে ১১তম অনুচ্ছেদে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে৷ সংবিধানের ৫ম ও ৬ঠ অনুচ্ছেদে ভারতীয় নাগরিক কারা তার উল্লেখ আছে৷ ১১তম অনুচ্ছেদে নাগরিকত্ব বিষয়ে আইন প্রণয়নের অধিকার দেওয়া হয়েছে সংসদ-কে৷ সংবিধান মেনেই ১৯৫৫ সালে সংসদের মাধ্যমে ‘ভারতের নাগরিকত্ব আইন’ প্রণয়ন করা হয়৷ এরপর বেশ কয়েকবার এই আইন সংশোধন করা হয়৷ যেমন ১৯৮৬, ১৯৯২, ২০০৩, ২০১৫ এবং সম্প্রতি ২০১৯ সালে সেই আইনের সংশোধন করা হয়েছে৷ সংবিধান সংশোধন ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে নাগরিকত্ব বিষয়টি পরিচালনা করা যায় না৷

ভারতের নাগরিকত্ব কত ধরণের? ২০০৩ সালে সংবিধান সংশোধনের পর ভারতে চার ধরণের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়৷ জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব (সিটিজেন বাই বার্থ) – ২৬ জানুয়ারি, ১৯৫০ তারিখে বা তার পরে ভারতে যাদের জন্ম, তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য৷  উত্তরাধিকারসূত্রে নাগরিকত্ব (সিটিজেন বাই ডিসেন্ট) – বিদেশে জন্মগ্রহণ করা ভারতীয় নাগরিকদের সন্তানদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য৷ নথিভূক্তকরণের মাধ্যমে নাগরিকত্ব (সিটিজেনশিপ বাই রেজিস্ট্রেশন)- ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন, এমন  স্থায়ী বসবাসকারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য৷ তবে এক্ষেত্রে তাদের অতি-অবশ্যই ভারতীয় বংশোদ্ভূত হতে হবে৷
বিদেশি নাগরিককে নাগরিকত্ব প্রদান (সিটিজেনশিপ বাই নেশন)-  ভারতে বৈধভাবে বসবাসকারী  বিদেশী নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য৷

জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের নিয়ম কী? ২০০৩ সালের সংবিধান সংশোধনের পর জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিকত্বের নিয়ম সময় অনুসারে তিন ধরনের৷ ২৬ জানুয়ারি, ১৯৫০ বা তার পরে কিন্তু ১ জুলাই, ১৯৮৭-র আগে ভারতের মাটিতে যাদের জন্ম, তারাই ভারতীয় নাগরিক৷ ১ জুলাই, ১৯৮৭ বা তার পরে কিন্তু ৮ জানুয়ারি, ২০০৪-এর আগে যাদের জন্ম ভারতে এবং জন্মের সময়ে যার বাবা কিংবা মায়ের মধ্যে কোন একজন ভারতীয় নাগরিক ছিলেন, তিনি জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক৷ ৮ জানুয়ারি ২০০৪  বা তার পরে যাদের ভারতে জন্ম হয়েছে এবং জন্মের সময়ে যার বাবা-মা উভয়েই ভারতীয় নাগরিক ছিলেন অথবা একজন ভারতীয় নাগরিক এবং অপরজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন, তিনি জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক৷

জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে ভারতের মাটিতে জন্ম হয়েছে, তা উল্লেখ করা হয়েছে৷ কিন্তু জন্ম যে ভারতেই হয়েছে, তার প্রমাণ কী? সাধারণত বার্থ সার্টিফিকেট বা জন্মের শংসাপত্রই হল জন্মের সময় ও জন্মস্থানের সঠিক প্রমাণপত্র৷ যে আইনে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়, ভারতে সেই আইনের নাম হল দ্য রেজিস্ট্রেশন অফ বার্থ অ্যান্ড ডেথস অ্যাক্ট, ১৯৬৯৷  ভারতে সেই আইন প্রথমবার প্রণয়ন হয় ১ এপ্রিল, ১৯৭০৷ অর্থাৎ ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি, থেকে ১৯৭০ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ভারতে বার্থ সার্টিফিকেটের কোনো আইনি ব্যবস্থা ছিল না৷ আবার পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ১ এপ্রিল, ২০০২-এর আগে পঞ্চায়েতের হাতে বার্থ সার্টিফিকেট দেওয়ার অধিকারও ছিল না৷ সুতরাং ২০০২ সালের ৩১ মার্চের আগে শহরের পুরসভা এলাকায় যাদের জন্ম হয়েছিল একমাত্র তাদেরই বার্থ সার্টিফিকেট থাকার কথা৷ ২০০২ সালের ১ এপ্রিলের আগে কোনো পঞ্চায়েত যদি এমন কোনো বার্থ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়ে থাকে, তা বেআইনি এবং গ্রহণযোগ্য হবেনা৷

বার্থ সার্টিফিকেটের ক্ষেত্রে সমস্যার সমাধান কি হবে?  এতদিন পর্যন্ত বাথ সার্টিফিকেটের পরিপূরক নথি হিসাবে মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ড কিংবা সার্টিফিকেট, স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট-কে মান্যতা দেওয়া হয়ে এসেছে৷ কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে ভারতবর্ষের এমন নাগরিকের (অন্তত যাদের বয়স ৪০ বা তার উপরে) সংখ্যাই বেশি যারা কোনদিন স্কুলের মুখ দেখেননি৷ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেননি, এমন মানুষের সংখ্যা তো আরো বেশি৷ এবিষয়ে আইনে স্পষ্ট করে কিছু উল্লেখ নেই৷ সেক্ষেত্রে একটা ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে৷ এক্ষেত্রে নতুন আইন প্রয়োগ করতে গেলে  অধিকাংশ ভারতীয়কেই সমস্যায় পড়তে হবে৷

তাহলে উল্লিখিত সময়ের আগে জন্ম বা সেই অর্থে বয়স্কদের ক্ষেত্রে কেউ ভারতীয় নাগরিক তার প্রমাণ কি? এক্ষেত্রে বলা যায়, উল্লিখিত সময়ে জন্মসূত্রে যারা ভারতীয় নাগরিক, তাদের সেই অর্থে কোনো প্রমাণপত্র নেই৷ কিন্তু পরবর্তীকালে যারা উত্তরাধিকারসূত্রে কিংবা নথিভূক্তকরণের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পেয়েছেন, তাদের প্রমাণপত্র আছে৷ কারণ তাদের নাগরিকত্বের জন্য লিখিতভাবে আবেদন করতে হয় এবং তাদের লিখিত সার্টিফিকেট দেওয়া হয়৷ সেই সার্টিফিকেটেই স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা থাকে কোনদিন থেকে তারা নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি পেলেন৷ জন্মসূত্রে যারা নাগরিকদের ক্ষেত্রে, যেহেতু এভাবে আবেদন করার কোনো নিয়ম নেই৷ তাই তাদের নাগরিকত্বের সার্টিফিকেটও নেই৷ তবে তাদের নাগরিকত্বের পরিচয় ভোটার কার্ড৷

নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে  ভোটার কার্ড নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়, সে ক্ষেত্রে কি করণীয়? ভোটার কার্ডের আসল নাম হল ইলেক্টর'স ফটো আইন্টিটি কার্ড বা এপিক (ইপিআইসি) কার্ড৷ এই কার্ড শুধুমাত্র ভারতীয় ভোটারদের জন্য৷ অর্থাৎ দেশের ভোটার তালিকায় যাদের নাম আছে৷ ভোটার কার্ডে  নাম, বাবার নাম, বয়স, ঠিকানা সবই থাকে৷ এমনকি কোন ব্যক্তি যে বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটার, তাও উল্লেখ করা থাকে৷ আরও থাকে ভোট কেন্দ্রের নাম ও পার্ট নাম্বার৷ ভোটার লিস্টে নাম না থাকলে এগুলো দেওয়া সম্ভব নয়৷

ভোটার হওয়ার শর্ত কি কি? ভারতীয় সংবিধানের ১৫তম অধ্যায়ের ৩২৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ১৮ বছরের উর্ধে প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকেরই ভোটদানের অধিকার রয়েছে, অর্থাৎ তারাই হলেন ভোটার৷ সংবিধান অনুযায়ী ভোটার হতে গেলে দুটি শর্ত আছে৷ প্রথমটি বয়স, আর দ্বিতীয়টি ভারতীয় নাগরিকত্ব৷ ভারতীয় নাগরিক না হলে ভোটার লিস্টে নাম ওঠার প্রশ্ন-ই ওঠে না৷ তাহলে যুক্তিগত দিক থেকে এটাই প্রমাণিত যে ভোটার লিস্টে নাম থাকলেই তিনি ভারতীয় নাগরিক৷ ইতিমধ্যেই অসমে নাগরিকত্ব সংশোধনী প্রক্রিয়া কার্যকর হয়েছে৷ সেখানে কিন্তু ১৯৫০ সালের এনআরসি-র তালিকা তৈরির সময়ে ১৯৫১ সালের নাগরিক পঞ্জি এবং ১৯৫২ সালের ভোটার তালিকাকেই ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে৷ ভোটার তালিকায় নাম থাকাটা সেখানেও নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবেই গৃহীত হয়েছিল৷ তাহলে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রে আলাদা নিয়ম কেন?

ভোটার কার্ড নিয়ে সংশয়ের কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে ভোটার তালিকায় প্রচুর বহিরাগতর নাম জুড়ে গেছে- এক্ষেত্রে 'ভুতুড়ে নাম' কথাটা উল্লেখ করা যেতে পারে৷ মজার ব্যাপার হলো, এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের ভোটের সংখ্যা বাড়াতে এই ধরনের ভূতুড়ে নাম নিজেরাই তালিকায় জুড়ে দেন যারা মৃত কিংবা বহুদিন ধরে এলাকায় নেই বা সেই ব্যক্তির বাস্তবে কোনো অস্তিত্বই নেই৷ যাতে পরে এই ভুতুড়ে নামের ভোটগুলি সহজেই নিজেদের দলের পক্ষে হয়ে যায়৷ প্রতি বছর নির্বাচন কমিশন তাই ভোটার লিস্ট সংশোধনের কাজ করে থাকেন৷ নতুন করে কিছু মানুষের নাম ওঠে, আবার অনেকের নাম বাদ-ও যায়৷ তারপরেও ফাঁক থেকেই যায়৷ কিন্তু সেই ভুতুড়ে নামের সংখ্যাটাও মাত্রাছাড়া নয়৷ ২০১১ সালের সেনসাস(জনগণনা) অনুযায়ী দেখা গেছে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা ছিল ৯.২০ কোটি৷ আর সেই বছরই ভোটার লিস্টে নাম ছিল মোট ৫.৬৩ কোটি মানুষের৷ অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৬১.১৯% ভোটার ছিলেন৷

নাগরিকত্বের প্রমাণপত্রের গুরুত্ব কি? নাগরিকত্বের প্রমাণ থাকলে তবেই সরকারি সমস্ত সুযোগ সুবিধা পাওয়া যাবে৷ সেই অর্থেই নাগরিকত্বের প্রমাণপত্রের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে৷ যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য,খাদ্য, কর্মক্ষেত্র, নাগরিক সুরক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে সমস্ত সুবিধা সরকারের দেওয়ার কথা৷ কিন্তু এতদিন যাবৎ দেশের নাগরিক হিসেবে যে প্রমাণপত্র দেখিয়ে এই সুবিধা পাওয়া যাচ্ছিল তার যথাযথ সুফল মিলেছে কি? বহু নাগরিক বঞ্চিত হয়েছেন এবং হচ্ছেন৷ তাহলে নতুন করে প্রমাণপত্র পাওয়ার পরেও সব নাগরিক যে যথোপযুক্ত সুবিধা পাবেন তার সুনিশ্চিত করে কোনও উল্লেখ নেই৷  

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এখন বলছেন,এনআরআইসি-তে নাম থাকাটাই নাগরিকত্বের একমাত্র প্রমাণ৷ এনআরআইসি কি? এনআরআইসি (ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন অফ ইন্ডিয়ান সিটিজেন) বা এনআরসি৷ ২০০৩ সালের দ্য সিটিজেনশিপ (রেজিস্ট্রেশন অফ সিটিজেন অ্যান্ড ইস্যু অফ আইডেন্টিটি কার্ড) আইনের-এর ৩(৩) বিধিতে উল্লেখ করা হয়েছে, এই তালিকায় কেবল ভারতীয় নাগরিকদের নাম, বাবামায়ের নাম, জন্ম তারিখ ও স্থান, ঠিকানা, বিয়ে হয়েছে কিনা, হয়ে থাকলে স্বামী অথবা স্ত্রী-র নাম, আইডেন্টিফিকেশন মার্ক থাকার কথা৷ বাকি তিনটে তথ্য সরকারি দপ্তর দেবে অর্থাৎ নাগরিকের রেজিস্ট্রেশনের নং ও তারিখ এবং ন্যাশনাল আইডেন্টিটি নাম্বার৷ এনআরআইসি কার্যকর হয়েছে ২০০৪ সালের ৮ জানুয়ারি৷ কিন্তু এখনও পর্যন্ত  এনআরআইসি করা যায়নি৷ তাহলে নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহ কেন? অবশ্য এই তালিকা তৈরি করা হলেও তাতে যে ভুল থাকবনা তাও তো নিশ্চিত করে বলা যায়না৷ কারণ, সাম্প্রতি অসম এনআরসি-তে ১৯ লক্ষ মানুষের নাম নেই৷ এর পরেও অজস্র ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’র  নাম তালিকায় উঠেছে বলে অভিযোগ উঠেছে৷ অর্থাৎ এই বিশাল সংখ্যক নাগরিকের এত হয়রানি করে যে তালিকা তৈরি হল তাতেও ত্রুটি থেকে গেল৷তাঁর থেকেও বড় প্রশ্ন এনআরআইসি-তে নাম থাকালেই যদি নাগরিকত্ব প্রমাণ করা যাবে, তাহলে যারা এই সরকারি কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন, তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ তো আগে দরকার৷ সেক্ষেত্রে কি করণীয় তার জনসাধারণের জানার উপায় নেই৷

সেনসাস,এনপিআর এবং এনআরসি-র মধ্যে পার্থক্য কি?  কেন্দ্রীয় সরকার তো বলছে এনপিআর সেনসাসের প্রথম ধাপ যার সঙ্গে এনআরসি-র কোন সম্পর্ক নেই, সেটা কতটা ঠিক? সেনসাস হল জনগণনা৷ সেখানে ভারতে বসবাসকারী নাগরিক-অনাগরিক নির্বিশেষে ডেমোগ্রাফিক ইনফরমেশন অর্থাৎ জনবিন্যাসগত তথ্য সংগ্রহ করা হয়৷ যেখানে কমপক্ষে ছ-মাস নির্দিষ্ট ঠিকানায় বসবাসকারীদের নাম, বাবামায়ের নাম, লিঙ্গ, জন্মতারিখ, শিক্ষা, পেশা ইত্যাদি৷  ভারতে প্রথম জনগণনার কাজ হয়েছিল ১৮৯১ সালে৷ তারপর থেকে প্রতি দশ বছর অন্তর জনগণনার কাজ হয়৷ এনপিআর(ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার) হল জাতীয় নাগরিক পঞ্জি৷ জনগণনার সঙ্গে এর মিল আছে একটি ক্ষেত্রে৷ এখানেও ডেমোগ্রাফিক ইনফরমেশন সংগ্রহ করা হয়৷ আর পার্থক্য হল, এনপিআর-এ একই সঙ্গে ডেমোগ্রাফিক ইনফরমেশন ও বায়োমেট্রিক ইনফরমেশন অর্থাৎ গায়ের রঙ, হাতের আঙুলের ছাপ, চোখের মনির রঙ ইত্যাদি৷ এগুলো আপনার শারীরিক পরিচিতির চিহ্ন সংগ্রহ করা হবে৷ এগুলি জনগণনার ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়না৷ যারমধ্যে কয়েকটি ইতিপূর্বে আঁধার কার্ডের জন্যেও সংগ্রহ করা হয়েছে৷ এরপরেও যদি নাগরিকত্ব নিয়ে সংশয় থেকেই যায় তাহলে আবার নতুন করে এসব করার অর্থ স্বাভাবিক ভাবেই জনসাধারণের বোধগম্য নয়৷ এনআরসি-র মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিকদের নাম, বাবামায়ের নাম, জন্ম তারিখ ও স্থান, ঠিকানা, বিয়ে হয়েছে কিনা, হয়ে থাকলে স্বামী অথবা স্ত্রী-র নাম, আইডেন্টিফিকেশন মার্ক সংগ্রহ করা হবে৷

একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, এনপিআর-এর তথ্য

এনআরসি-র ক্ষেত্রেও প্রয়োজন৷ সুতরাং শুধু জনগণনার জন্যই এনপিআর করা হচ্ছে বলে কেন্দ্র দাবি করলেও আসলে এখান থেকেই কিন্তু এনআরসি-র তথ্য সংগ্রহ করার কাজও হয়ে যাবে৷ যা সাধারণ মানুষকে বুঝতেও দেওয়া হবেনা৷ আর এনপিআর-এর তথ্য যারা সঠিকভাবে দিতে পারবেন না তখনই তাদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে৷ এরপর নাগরিক তালিকা থেকে নাম কাটা যাওয়ার নোটিশ হাতে এলে তখনই বোঝা যাবে যে এনপিআর হল এনআরসি-র প্রথম ধাপ৷ যা  মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়  কিন্তু প্রথম দিন থেকেই দাবি করেছেন৷
 
কেন্দ্রিয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, এনপিআর-এ বাবামায়ের জন্মতারিখ ও জন্মস্থান জানতে চাওয়া হবে, সেটা কতটা যুক্তিযুক্ত ?  সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য জানার অধিকার নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে সংবিধানে৷ সেক্ষেত্রে সরকার এই আইন মানতে বাধ্য৷ এনপিআর-এর ক্ষেত্রেও সেটি সমানভাবে প্রযোজ্য সরকার কতটুকু তথ্য চাইতে পারে, তার পরিসীমা নির্দিষ্ট করা আছে সংশ্লিষ্ট নিয়মে-এ৷ তবে বাবা-মায়ের জন্মের তারিখ ও জন্মস্থান তার মধ্যে পড়ে না৷ প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে প্রত্যেকের বাবা-মায়ের জন্মের তারিখ বা জন্মস্থান দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হতেই পারে৷ কারণ এখনো পর্যন্ত বহু বয়স্ক নাগরিকের এই সংক্রান্ত নথি নানান কারণে অমিল৷ যেহেতু সরকারি নিয়ম অনুসারে এর আগে নাগরিকদের এত কড়াকড়ি নিয়ম বিধি ছিলোনা৷ তাই অনেকেই এই বিষয়গএখন নতুন করে সেসব সংগ্রহ করতে হলে বড়োসড়ো সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে৷ অর্থাৎ এক্ষেত্রে নিজেদের সমস্ত নথি থাকলেও বাবা-মায়ের নথি সংগ্রহ করতে আবারও চূড়ান্ত হয়রানি৷
 কিন্তু কেন্দ্র সরকার বলছে ১৯৮৭-র ১ জুলাই বা তারপরে তার জন্ম যদি ভারতে হয়েও থাকে, তাহলেও তার বাবা অথবা মায়ের ভারতীয় নাগরিক হওয়াটা অত্যাবশ্যক৷ নাহলে সেই শিশু ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবে না৷ সেক্ষেত্রে বাবামায়ের নাম ছাড়া তাদের সম্পর্কে অন্য কোন তথ্য অনেকেরই অজানা থাকতে পারে৷ তেমন কোনো নথিও  নাই থাকতে পারে৷ উল্লেখযোগ্যভাবে এই নিয়ম নাগরিকত্ব আইনে উল্লেখ নেই, এমনকি  সংবিধানের নিয়মেও উল্লেখ নেই যে বাধ্যতামূলকভাবে এই তথ্য কোন বর্তমান নাগরিককে দিতে হবে৷  

সরকারের কাছে দেশের অধিবাসী বা নাগরিকদের একটা বিস্তারিত তালিকা থাকার প্রয়োজন কতটা? সরকারের কাছে দেশের নাগরিকদের একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা থাকার অবশ্যই প্রয়োজন আছে৷ নাগরিকদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা দিতে গেলে সেই তালিকা অবলম্বন করতে হয়৷ কিন্তু সমস্যা হল আজ পর্যন্ত এই ধরনের তালিকা গুলিতে ভুলত্রুটি থেকেই গেছে৷ বিশেষ করে তালিকাভুক্ত আছেন বহু অবৈধ নাগরিক এমনকি অনুপ্রবেশকারীরাও৷ একাধিকবার সংশোধনের পরেও এই ত্রুটি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি৷ সেই অর্থেই এই তালিকার গুরুত্ব অনেকটাই খাটো হয়েছে৷

প্রশ্ন ওঠে দেশে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে পারলে বৈধ নাগরিকরা সরকারি উন্নয়নমূলক কাজের দ্বারা সত্যিই কতটা সুবিধা পাবেন?  অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বিশ্বের সমস্ত দেশেই আছে৷ সম্প্রতি জানা যাচ্ছে, ব্রিটেনে নাকি এক লক্ষ ভারতীয়কে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ তাদের ফেরত পাঠানোর জন্য ভারত সরকারের সঙ্গে চুক্তি করতে চেয়েছিল ব্রিটেন কিন্তু ভারত সরকার সেই চুক্তি স্বাক্ষর পিছিয়ে দিয়েছে৷ তাহলে কি ভারতবাসী মানেই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী? নিশ্চয়ই নয়৷ ভারতেও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী আছেন৷ সংখ্যাটা সঠিক কত, তা এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট নয়৷ ২০০১ সালের সেনসাস রিপোর্টে বলা হয়েছিল প্রায় ৩১ লক্ষ মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসেছেন৷ পরবর্তীকালের সেনসাস রিপোর্ট থেকে এই জাতীয় কোন তথ্য জানা যায়নি৷ অনেকেরই অজানা যে,  জাতি সঙ্ঘের ১৯৫১ সালের রিফিউজি কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি ভারত৷ ফলে ভারতে বৈদেশিক শরনার্থী কিংবা আশ্রয়প্রার্থী এই ধারণার আইনি অস্তিত্বই নেই৷

কেন্দ্র সরকার বলছেন এই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে অসহায় শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে৷ সেখানে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসিক ও খ্রিস্টান সম্প্রদায় ভুক্ত নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা কতটা সঠিক?  নাগরিকত্ব সংশোধনীতে নাকি আফগানিস্থান, পাকিস্থান ও বাংলাদেশ থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪-র আগে ভারতে চলে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর তালিকা থেকে বাদ দেবার কথা বলা হয়েছে৷ কিন্তু নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯-এ সম্প্রদায়ের পাশাপাশি আরো অনেক কিছু প্রমাণ দাবি করা হয়েছে৷
সংশোধনীর ২ নং ধারার শুরুতে এই সম্প্রদায়ের মানুষদের কথা উল্লেখ করা হলেও৷ একই সঙ্গে বলা হয়েছে, যারা পাসপোর্ট(এন্ট্রি ইন টু ইন্ডিয়া) অ্যাক্ট, ১৯২০ কিংবা ফরেইনার্স অ্যাক্ট, ১৯৪৬-এর আওতায় শুধুমাত্র তাদেরকেই অনুপ্রবেশকারীর তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে৷ অর্থাৎ, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অনুসারে অভিবাসীদের ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪-র আগে  আফগানিস্থান, পাকিস্থান বা বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসতে হবে ও তাকে সেই দেশের হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্শি অথবা খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে৷ পাসপোর্ট(এন্ট্রি ইন টু ইন্ডিয়া) অ্যাক্ট, ১৯২০ কিংবা ফরেইনার্স অ্যাক্ট, ১৯৪৬ তাদের ওপর প্রযোজ্য নয় যারা ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে অথবা সেই ভয়ে পাকিস্থান বা বাংলাদেশ থেকে এসে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন৷ এরমধ্যে আবার নতুন আইনে আফগানিস্থানের কথা বলা হলেও অন্য দুটো আইনে দেশের উল্লেখ নেই৷ কাজেই আফগানিস্থান থেকে আগত শরণার্থীরা আইনত বাদ পড়ে যাচ্ছেন৷ পাশাপাশি ৩১.১২.২০১৪-র আগে ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে ভারতে আসা শরনার্থীদের প্রমাণ করতে হবে যে তারা সত্যিই কি কারণে ভারতে এসে আশ্রয় নিয়েছেন৷

২০১৯ –এর আগে ২০১৬ সালেও এই মর্মে আইন সংশোধনের প্রস্তাব লোকসভায় পাশ হয়েছিল৷ রাজ্যসভা সেটাকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠায়৷ সেই সময় আই বি- দফতরের  ডি জি জানিয়েছিলেন সংশোধনীর মাধ্যমে কতজন নাগরিকত্ব পেতে পারেন৷ দেশে এমন মানুষের সংখ্যা ৩১,৩৪২৷ তবে তারা সত্যিই ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার সেটা প্রমাণ হবে কিভাবে, তার উত্তর স্বয়ং  ডি জি-ও দিতে পারেননি৷ তবে তিনি বলেছিলেন এর জন্য জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগে র-এর সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় নেই৷

সুতরাং এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন যতটা সহজ বলে বোঝাতে চাইছে কেন্দ্র সরকার তার তুলনায় দ্বিগুণ জটিল৷ এবং এতে শুধু নাগরিকদের হয়রানি নয় চরম বিপদের আশঙ্কাও থাকছে৷ তার থেকেও বড় কথা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে সংবিধান লঙ্ঘন করা হয়নি বলে দাবি করা হলেও সংবিধান যে অমান্য করা হয়েছে তা সুস্পষ্ট৷ সুতরাং দেশের কোটি কোটি নাগরিকের আইনি অধিকারে হস্তক্ষেপ করে এই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া আর কোনও উপায় রাখেনি স্বয়ং কেন্দ্রীয় সরকার৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

18 − nine =