তপন মল্লিক চৌধুরী : তাঁর দলে থাকা কিংবা বিজেপিতে যোগদান ঘিরে জল্পনা চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে। এবার নিজেইসেই জল্পনা আরও উসকে দিলেন। এখন কবে দিল্লি যাচ্ছেন, কবে বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন, বিধায়ক পদ ছাড়ছেন কিনা সেই চর্চা চলবে। যা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে পুরোদমে। শুক্রবার দুপুরেনন্দীগ্রামের বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী তাঁর ইস্তফা পত্র নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠান। তিনি রাজ্যের পরিবহণ, সেচ ও জলসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী ছিলেন।তার আগে বৃহস্পতিবার তিনি হুগলি রিভার ব্রিজ কমিশনার্স-এর চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দেন৷মন্ত্রিত্ব ছাড়ার পর শুভেন্দু হলদিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটি-র চেয়ারম্যানের পদ থেকেও পদত্যাগ করেছেন। প্রসঙ্গত, শুভেন্দুর দুটি চিঠির বয়ান প্রায় একইরকম। মুখ্যমন্ত্রী এবং নগরোন্নয়ন ও পুরমন্ত্রী দু;জনকেইতিনি লিখেছেন, ‘মানুষকে সেবা করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি যথাসাধ্য নিজের প্রতিশ্রুতি রাখার চেষ্টা করেছি’।
উল্লেখ্য; দলীয় পর্যবেক্ষক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর থেকে শুভেন্দুর সঙ্গেদলের দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। দলে নিষ্ক্রিয় থাকলেও তিনি জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। গত কয়েকমাস ধরে তিনি বহুজায়গায় গিয়েছেন এবং সভা করেছেন। সেই সব সভা দিদির নয়, ছিল দাদার সভা, সেখানে তৃণমূল কংগ্রেসের পতাকা,পোস্টার,ব্যানার এমনকি তৃণমূল নেত্রীর কোনও ছবি ছিল না।সভামঞ্চ থেকে শুভেন্দু কখনও দলের বিরুদ্ধে সরাসরি ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন। কখনও দলে ভূমিকার কথাও বলেছেন। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে শুভেন্দুর বক্তব্য রাজ্যের রাজনীতিতে চরম শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। এটা প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে নন্দীগ্রামের দাপুটে নেতা এবার কোনও বড়সড় পদক্ষেপ নিতে চলেছেন।
শুভেন্দুর ক্ষোভ-অভিমানে প্রলেপ দিতে স্বয়ং মমতার নির্দেশে দলের বর্ষীয়ান নেতা সৌগত রায় ওসুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়শুভেন্দুর সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন। তাতে বরফ কিছুটা হলেও গলতে শুরু করেছে বলে মনেহয়েছিল। রামনগরের সভায় শুভেন্দু অধিকারীর দল ছাড়া নিয়ে যখন জল্পনা চরমে পোঁছয়, তখন শুভেন্দু সাফ জানান, নেত্রী আমাকে ছাড়েননি, আর আমিও দল ছাড়িনি। তারপরও তৃণমূলের অন্দেরর রাজনীতিতে বহু জল গড়ায়। শুভেন্দুকে নিয়ে আচমকা সরব হয়েওঠেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। একদিকে কল্যাণের অপ্রিতিকর কথাবার্তা তারপরই বাঁকুড়ার সভায় মমতার ‘ছাগলের তৃতীয় সন্তান’ নিয়ে মন্তব্যই মনে হচ্ছে শুভেন্দুর সঙ্গে দলের সম্পর্ক কার্যত চিড় ধরাতে সাহায্য করল।
নন্দীগ্রাম আন্দোলন থেকেই শুভেন্দুর রাজনৈতিক উত্থান। তিনি বরাবরই দলের এবং নেতৃর অনুগত সৈনিক। যখনই নেত্রী তাঁকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা তিনি পালন করেছেন। দলের অনুশাসনের বাইরে যেতে তাঁকে দেখা যায়নি। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেইশুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের দূরত্ব বাড়ছিল। নন্দীগ্রাম দিবস থেকে সেই দূরত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একসময় শুভেন্দু জানিয়েছিলেন, তৃণমূল কংগ্রেসে সবাই কর্মী। একজনই নেত্রী। তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আমরা সবাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৈনিক। কিন্তু তৃণমূলের সঙ্গে দূরত্ব তৈরির ফলেই শুভেন্দু গরহাজির থাকছিলেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। শুধু তাই নয়, শুভেন্দু অধিকারী নিজের মতো করে জনসংযোগ করছিলেন। সেখানে দলের কোনও সংস্পর্শ থাকছিল না। শুভেন্দু অনুগামীরাও একেবারে ভিন্ন কর্মসূচিতে শুভেন্দুকে প্রচারের আলোয় আনছিলেন।
গত কয়েক মাস তাঁর চলা ফেরা কিংবা আচরণ কখনই দলের প্রতি গভীর আনুগত্য প্রকাশ করে নি। তখন থেকেই তিনি ভাবছিলেনতৃণমূল কংগ্রেসে থাকবেন কিনা। মেদিনীপুরে তখন তিনি এমন সভাও করেছেন; যেখানে নেত্রীর ছবি এমনকি দলের প্রতীক চিহ্ন ছিল না। তাঁর নিজের ছবিতেই ভরে থাকত সভাস্থল এমনকি আশপাশ। আজ তিনি সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে দিলেন। সৌগত রায়ের সঙ্গে বৈঠকে শুভেন্দু দলের কাজে আরও স্বাধীনতা দাবি করেছিলেন। সেইসঙ্গে যে ৬টি জেলার তিনি পর্যবেক্ষক ছিলেন, সেগুলি তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথাও বলেছিলেন। দ্বিতীয় দফার বৈঠকে তাঁর পছন্দের বেশ কয়েকজন নেতাকে ভোটের টিকিট দেওয়ার কথাও বলেছিলেন।
কিন্তু গোটা প্রক্রিয়াটা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেল মুখ্যমন্ত্রীর বাকুড়া সফরে কল্যাণকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ায়। তারপর থেকেই নতুন করে জল্পনা তৈরি হতে থাকে। পাশাপাশি প্রশ্ন ওঠে, তবে কি কল্যাণ শুভেন্দুকে উদ্দেশ্য করে যেসব মন্তব্য করেছেন তাতে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সায় রয়েছে?
অন্যদিকে বাঁকুড়ার সভামঞ্চ থেকেনেতৃ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাফ জানিয়েছিলেন, তিনিই সারা বাংলার ‘পর্যবেক্ষক’। একইসঙ্গে তিনি এও বলেছিলেন, কে বা কারা বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, সেই খবরও তাঁর কাছে রয়েছে। প্রসঙ্গত; নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুর এই দুই আন্দোলেনের জেরেই এ রাজ্যে পালাবদল হয়েছিল। তৃণমূলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর শুভেন্দু অধিকারীই সবচেয়ে বড় নেতা। বছর ঘুরলেই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। এবার বিজেপির সঙ্গে কঠিন লড়াই। এই সময়ে শুভেন্দু যদি দল ছাড়েন তাহলে কি ফল ভাল হবে?