তপন মল্লিক চৌধুরী : বছর ঘুরতেই এ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। কিন্তু তার আগে রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতিক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে। একই দিনে নন্দীগ্রামের দাপুটে তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী মন্ত্রিসভা থেকেইস্তফা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে ছেড়েছেন অন্যান্য সরকারি পদ।আর ওই দিন রাতেই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন কোচবিহার দক্ষিণ কেন্দ্রের বিধায়ক মিহির গোস্বামী। একই দিনে রাজ্যের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তের দুই তৃণমূল বিধায়কঅঘটন ঘটালেন।যদিওশুভেন্দু বিধায়ক পদ ছাড়েন নি এবং দল থেকেও বেড়িয়ে যান নি। অন্যদিকে মিহির গোস্বামী আগেই দলের যাবতীয় পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন সেই সঙ্গে বিধায়ক পদ ছাড়ার কথাও জানিয়েছিলেন।
তৃণমূল কংগ্রেসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর সবথেকে বড় জননেতার নাম শুভেন্দু অধিকারী এ বিষয়ে কোনও বিতর্ক নেই।তবে দীর্ঘ দিন ধরে তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। তৃণমূলের কোনও সভা-সমাবেশে তিনি হাজির হতেন না। দলীয় কোনও কার্যকলাপেতাঁকে দেখা যেত না। এই জটিলতা থেকে জল্পনায় তাঁর বিজেপিতে যোগদান প্রায় নিশ্চিত হয়ে উঠেছিল।
অন্যদিকেবহুদিন ধরে দলের সঙ্গেবনিবনা হচ্ছিল নাকোচবিহার জেলার জনপ্রিয় তৃণমূল নেতা মিহির গোস্বামীর। বেশ কিছুদিন ধরেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছিলেন তিনি৷ বিরোধ শুরু হয়েছিল কোচবিহার জেলা তৃণমূল কমিটির গঠন নিয়ে।তখনথেকেইদলের সঙ্গে মতবিরোধহতেথাকে। সেইবিরোধিতাশেষমেশ এমন পর্যায়ে পৌঁছয়তারজেরে সাংগঠনিক পদ ছাড়তেবাধ্যহনতিনি৷ মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে দলের নেতা-মন্ত্রী এবং টিম পিকের বিরুদ্ধে সুর চড়ান তিনি৷ এরপরইসামাজিকমাধ্যমে একরাশ অভিমান উগড়েদিয়েতিনিলেখেন, ‘বাইশ বছর আগে যে দলটিতে যোগ দিয়েছিলাম, আজকের তৃণমূল সেই দল নয়। এই দলে আমার জায়গা নেই। তাই আজই তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাই’।
শুভেন্দু অধিকারী কেবল তৃণমূল সরকারের মন্ত্রী ছিলেন না। তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের সুদক্ষ সংগঠকও নেতা ছিলেন।তিনি যে এলাকার বিধায়ক ছিলেন, সেই নন্দীগ্রাম আন্দোলন থেকেই শুভেন্দুর রাজনৈতিক উত্থান। বরাবরইতিনি দলের অনুগত সৈনিক হিসাবে পরিচিত ছিলেন। দলনেত্রী যখনই তাঁকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা তিনি পালন করেছেন। দলের অনুশাসনের বাইরে যেতে তাঁকে দেখা যায়নি। তবে বেশ কিছুদিন ধরেই শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের দূরত্ব বাড়ছিল। নন্দীগ্রাম দিবস থেকে সেই দূরত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তার আগে তৃণমূলে এবং মমতার কাছে তিনি যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়ে এসেছেন। কিন্তু যখন থেকে দলেনেত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় গুরুত্ব পেতে শুরু করে; তখন থেকেই শুভেন্দুর সঙ্গে সংঘাতের শুরু। এছাড়া সারদা ও নারদ-কাণ্ডে শুভেন্দুর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর থেকেই চাপের মুখে পড়েন শুভেন্দু। তার আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে পাঁচটি জেলার সংগঠনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সে কাজ তিনি দক্ষতার সঙ্গেই পালন করেছেন। সেসব জেলায় তাঁর কিছু অনুগামীও তৈরি হয়েছে।
সবাই বলছেন শুভেন্দুর দল ছাড়া এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। প্রশ্ন শুভেন্দু তৃণমূল ছাড়লে তিনিকি বিজেপিতে যোগ দেবেন, নাকি নিজেই আলাদা দল গঠন করবেন?শুভেন্দু দল ছাড়লে বিধানসভা ভোটের আগে মমতার কতটা ক্ষতি? শুভেন্দু যে মাপের নেতা ছিলেন তাতে পূর্ব মেদিনীপুরের আসনগুলি তৃণমূলের হাত থেকে বেড়িয়ে যেতেই পারে। এ ছাড়া যেসব জেলায়শুভেন্দু দায়িত্বে ছিলেন, সেখানে দলের ভোট যে কমবে সে কথাও ঠিক। অনেকে বলছেন, শুভেন্দু তৃণমূল ছাড়লে তৃণমূলে একটা ধস নামবে বা ভাঙন ঘটবে। বেশ কয়েকজন বিধায়ককে সঙ্গে নিয়েই তিনি দল ছাড়বেন।
যে দল একক নেতৃত্ব-ক্ষমতা এবং ক্যারিশমায় চলে। যে দলে একমাত্র মমতাই শেষ কথা। দলের জয় পরাজয়ের একমাত্র কাণ্ডারিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেই দল থেকে শুভেন্দু বেড়িয়ে যাওয়া মানে তৃণমূলের বেশ কয়েকটা আসনহাতছাড়া হওয়া। এর থেকে যে বেশি কিছু নয় তা শুভেন্দুও ভাল জানেন। কারণ তৃণমূল দলে এমন কেউ নেই যে মমতাকে তাঁর একক ক্ষমতায়বিপাকে ফেলতে পারবেন।কিন্তু মাস দুই-তিন পরেই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। রাজ্যে ভোটে এবার তৃণমূল বিজেপি হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। কংগ্রেস-বামেরা জোট বেঁধেছে। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের পক্ষে কয়েকটি আসন ক্ষোয়া যাওয়া মানে অনেকটাই পিছিয়ে পড়া।
মানুষ এর আগেও মমতাকে দেখেই ভোট দিয়েছেন এবার যাঁরা দেবেন, তাঁরা মমতাকে দেখেই দেবেন। সেখানে শুভেন্দু বা অন্য কারও কোনও ভূমিকা ছিলনা আজও নেই। কিন্তু আজসময়টা বেশ জটিল। তাই শুভেন্দু দল ছাড়লে বা নতুন দল গড়লে তাতে সামান্য হলেও ফায়দা একমাত্র বিজেপির। যার জন্য তাঁরা মুখিয়ে আছে। কারণ তাদের নিজেদের ক্যারিশমায় মমতার ভোট কেড়ে নেওয়ার মতো ক্ষমতা তাদের নেই। তাই বিজেপি সব সময়েই চায়, মমতার ভোট কমাতে। সেটা না করতে পারলে তাদের এগোনো সম্ভব নয়।শুভেন্দু মমতা নন যে নতুণ দল গড়ে সাফল্যমন্ডিত হবেন। সেটা মমতা ছাড়া আর কেউ পারেন নি। অজয় মুখোপাধ্যায় থেকে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মতো রাজনীতিকও পারেন নি।সইফুদ্দিন চৌধুরী, সমীর পুততুন্ডরাও চরম ব্যর্থ হয়েছেন। শুভেন্দু নতুন দল গড়তেই পারেন তবে তার ফায়দা পাবে একমাত্র বিজেপি।
-ফাইল ছবি, অনুগামীদের পোস্টার৷