কলকাতা: ভোট কুশলী প্রশান্ত কিশোরের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস গাঁটছড়া বাঁধার পর নতুন বিতর্ক শুরু হয় বঙ্গ রাজনৈতিক মহলে। তবে তথাকথিত ‘গরিব’ রাজনৈতিক দল কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করে প্রশান্ত কিশোরের সঙ্গে হাত মেলানোর পরেও নিজেদের ভাঙ্গণ রুখতে পারল কি? এই মুহূর্তে তৃণমূল কংগ্রেসের যা পরিস্থিতি, তাতে উত্তর হতে পারে একটাই, না। এর সবচেয়ে বড় কারণ, মুকুল রায়কে বাদ দিলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরে তৃণমূল কংগ্রেসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতার মন্ত্রিত্ব ত্যাগ। শুভেন্দু অধিকারী মন্ত্রিত্ব পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পরেই ভোট কুশলী প্রশান্ত কিশোরের কর্ম ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেল স্বাভাবিকভাবেই। আর কয়েক মাস পরেই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসকে মাটিতে মেশাতে বহুদিন আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছে বিজেপি। তার আগে তৃণমূলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রীর এইভাবে পদত্যাগ অবশ্যই চরম অস্বস্তি বাড়িয়েছে তৃণমূলে।
লোকসভা নির্বাচনের পরবর্তী সময়টাকে যদি ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায়, তাহলে দেখা যাবে ভোট কুশলী প্রশান্ত কিশোরের নির্দেশ অনুযায়ী একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। বিভিন্ন প্রকল্প যেমন ঘোষণা করা হয়েছে, তেমনই সাধারণ একাধিক জনসংযোগ মূলক প্রচার শুরু করা হয়েছে। এই সব সিদ্ধান্তের পেছনে মূল মাথা প্রশান্ত কিশোর, তাহলো করে বলা না গেলেও কার্যত সেটাই বাস্তব। তবে প্রশান্ত কিশোরের তৃণমূল কংগ্রেসে গুরুত্ব বাড়ায় দলের অন্দরে যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল তা প্রথম থেকেই স্পষ্ট বোঝা গেছে। একইসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ তথা বাড়ির সদস্যকে নিয়ে যে দলের অন্দরে মতভেদ রয়েছে তাও স্পষ্ট। আর এই বিরোধিতার অন্যতম মুখ হয়ে গিয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। বিগত কয়েক মাসে তিনি প্রশাসনিক কাজে খুব একটা মনোযোগ দিতেন না, এমনকি কোথাও জনসভা করলেও সেখানে না থাকতো দলীয় পতাকা না থাকতো তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যানার। একাধিক সূত্রের খবর ছিল, প্রশান্ত কিশোরের ভূমিকা নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন তিনি।
তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে প্রশান্ত কিশোর এবং তাঁর কমিটি, এটা কিছুতেই মানতে পারছিলেন না শুভেন্দু। অন্যদিকে তৃণমূলের অন্য একজন সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরোক্ষভাবে একটা ‘কোল্ড ওয়ার’ শুরু হয় তাঁর। শুভেন্দু প্রসঙ্গে একাধিক ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করতে থাকেন করলেন। পরে এইচআরবিসি-র চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর শুভেন্দুর জায়গায় কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়োগ করা হলে উত্তেজনা আরো বাড়ে। তার আগে রামনগরের সভায় শুভেন্দুর ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্যের পর দলে অস্বস্তি’ চরম মাত্রায় পৌঁছয় তৃণমূলের। পরবর্তী ক্ষেত্রে শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে বৈঠক করে তৃণমূল কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন। কিন্তু আখেরে যে শুভেন্দু অধিকারীর মান ভাঙাতে তাঁরা পারেননি, সেটা স্পষ্ট।
তবে শুভেন্দু অধিকারীর মানভঞ্জন করতে না পারার দায়িত্ব কি শুধু তৃণমূল নেবে, নাকি প্রশান্ত কিশোরকে এর দায় স্বীকার করতে হবে? এই বিষয়ে বলতে গেলে অবশ্যই বলা যায়, ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের আগে শুভেন্দু অধিকারীর পদত্যাগ প্রশান্ত কিশোরের জন্য বড় ধাক্কা। কারণ যে ভোট কুশলী প্রশান্ত কিশোরকে এনে বাংলার নির্বাচনে বাজি মাত করতে চেয়েছে তৃণমূল, সেই প্রশান্ত কিশোর দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর মন বদলাতে পারলেন না! এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতেই পারে, শুধুমাত্র একজন মন্ত্রীর সিদ্ধান্ত যদি প্রশান্ত কিশোর বদল করতে না পারেন, তাহলে সেই মন্ত্রীর কয়েক হাজার অনুগামীদের মন বদলাবেন কি করে। কারণ যে জেলাগুলিতে শুভেন্দু অধিকারীর প্রতিপত্তি, সেই জেলাগুলির ভোট শতাংশ যদি খেদ পড়ে তাহলে তৃণমূল কংগ্রেসের কোন কিছুই করার থাকবে না। এক্ষেত্রে প্রশান্ত কিশোরকেও চুপচাপ বসে থাকতে হবে। শুভেন্দু অধিকারীর পদত্যাগের পর সবচেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়েছে বঙ্গ বিজেপি ব্রিগেড।
ইতিমধ্যেই তাদের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে, শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যোগদান করতে চাইলে তারা সাদর ভাবে আমন্ত্রণ জানাবেন। যদিও এখনই তিনি বিজেপিতে যোগ দেবেন কিনা সে ব্যাপারে কিছুই বলেননি শুভেন্দু। কিন্তু যদি তিনি বিজেপিতে যোগ দেন, সেক্ষেত্রেও তৃণমূল কংগ্রেসের প্রশান্ত কিশোরের আরো চাপ বাড়বে। কারণ শুভেন্দু যে দলে যাবেন, স্বাভাবিকভাবে তাঁর সাংগঠনিক ভোট সেই দিকেই যাবে। এখন দেখা যাচ্ছে, বাংলার নির্বাচন যদি নির্ধারিত সময় হয়, তাহলে তৃণমূলের ক্ষেত্রে রিজার্ভ প্ল্যান তৈরি করা খুব মুশকিল। এক্ষেত্রে প্রশান্ত কিশোরও যে খুব একটা কিছু করতে পারবেন তার আশা না রাখাই ভালো। কারণ ভোট কুশলীর কৌশল যদি ঠিকমতো কাজ করতো, তাহলে শুভেন্দু অধিকারীকে হয়তো হারাতে হত না তৃণমূলকে। তবে এখনো হয়তো সবকিছু ভুলে বাংলা বাঁচানোর লড়াইয়ে আরো কোমর বাঁধবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্রিগেড। তবে ব্যর্থ হোক, কি সফল, আপাতত তৃণমূল সুপ্রিমো ভরসা রাখছেন প্রশান্তের কৌশলের উপরই।