নয়াদিল্লি: দীর্ঘ লড়াইয়ের অবসান৷ প্রয়াত প্রণব মুখোপাধ্যায়। সেপটিক শকে চলে গিয়েছিলেন প্রণব বাবু। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। ভারতের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় ছয় দশকব্যাপী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের এই প্রবীণ নেতা ২০১২ রাষ্ট্রপতি পদের কার্যভার গ্রহণ করেন। তাঁর আগে প্রণববাবু ভারতের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বও সামলেছিলেন।
১৯৬৯ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হাত ধরে কংগ্রেসে পদার্পণ করেছিলেন প্রণব বাবু। ১৯৭৩ সালে ইন্দিরা গান্ধীর ক্যাবিনেট মন্ত্রিসভায় স্থান পান। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ পর্বে তিনি ছিলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত তিনি রাজ্যসভার দলনেতা ছিলেন। ভারত-মার্কিন অসামরিক পরমাণু চুক্তি সাক্ষরের মতো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক ঘটনায় প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অবদান অনস্বীকার্য। দেশের প্রতি আনুগত্য প্রদানের জন্য তাঁকে 'ভারতরত্ন' ও 'পদ্মবিভূষণ' সম্মানে সম্মানিত করা হয়েছে। পাশাপাশি তিনি শ্রেষ্ঠ সাংসদের সম্মানও পেয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালে, যুক্তরাজ্যের ইউরোমানি পত্রিকায় তাঁর নাম সেরা পাঁচ অর্থমন্ত্রীর তালিকায় প্রকাশ করা হয়েছিল।
১১ ডিসেম্বর ১৯৩৫ সালে অবিভক্ত বাংলার বীরভূম জেলার কীর্ণাহার শহরের নিকটস্থ মিরাটি গ্রামে প্রণব বাবু জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় ১৯২০ সাল থেকে কংগ্রেসের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। প্রণব মুখোপাধ্যায় সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াশোনা করেছেন। কলেজশিক্ষক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন প্রণব বাবু। এরপর সাংবাদিকতার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন কিছুদিন। হাওড়া জেলার বাঁকড়ায় অবস্থিত “বাঁকড়া ইসলামিয়া হাইস্কুল”র ২ বছর শিক্ষকতা করেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।
প্রণব মুখোপাধ্যায় ১৯৬৯, ১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৯৩ ও ১৯৯৯ সালে পরপর পাঁচবার কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে ক্যাবিনেটে যোগ দেন। পদোন্নতির পর ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় ড. মনমোহন সিংহ ছিলেন ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর। ইন্দিরা হত্যার পর গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের শিকার হন প্রণব। এরপর কংগ্রেস থেকে কিছুকালের জন্য বিতাড়িত হন তিনি। ১৯৮৯ সালে আবার যোগ দেন। এরপর নরসিমা রাও এর আমলে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হন প্রণব।
২০০৪ সালে, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট কেন্দ্রে সরকার গঠন করে। এই সময় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ রাজ্যসভার সদস্য হওয়ায়, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের লোকসভায় কংগ্রেস দলনেতার দায়িত্ব পান। তিনি সারা দেশের কংগ্রেস সাংসদ ও বিধায়কদের নিয়ে গঠিত যথাক্রমে কংগ্রেস সংসদীয় দল ও কংগ্রেস বিধানসভা দলেরও প্রধান। তিনি আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাংকের বোর্ড অফ গভর্নরসের সদস্য। ১৯৮৪ সালে প্রণব মুখোপাধ্যায় আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার ও বিশ্ব ব্যাঙ্কের সঙ্গে সংযুক্ত গ্রুপ অফ টোয়েন্টিফোরের সভাপতিত্ব করেন প্রণব বাবু।
মনমোহনের আমলে সোনিয়া গান্ধী ও মনমোহনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বেড়ে ওঠে। ২০০৪ সালে দল ক্ষমতায় এলে প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সম্মানজনক দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ২০০৫ সালে পেটেন্ট অ্যামেন্ডমেন্ট বিল পাসের ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। যদিও এই বিল তাঁর অধীনে ছিলনা। মনমোহন সিংহ দ্বিতীয় বারের জন্য দ্বায়িত্ব পেলে প্রণব বাবু অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব পান। ২০০৯ সালের ৬ জুলাই তিনি সরকারের বার্ষিক বাজেট পেশ করেন। এই বাজেটে কয়েকটি কর সংস্কারের প্রস্তাব রাখেন প্রণব বাবু। এই কর ব্যবস্থার পরিকাঠামোর প্রশংসা করেন বিভিন্ন কর্পোরেট কর্মকর্তা ও অর্থনীতিবিদগণ। পাশাপাশি তিনি কয়েকটি সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্পে অর্থবরাদ্দ করেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান সুনিশ্চিতকরণ আইন, শিশুকন্যাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা ইত্যাদি। জাতীয় সড়ক উন্নয়ন কর্মসূচি, বিদ্যুদয়ন প্রকল্প, এবং জওহরলাল নেহেরু জাতীয় নগরোন্নয়ন মিশনের মতো পরিকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প গুলিতেও তিনি অর্থ বরাদ্দ করেন।
২০১২ সালের পর এনডিএ প্রার্থী লোকসভার সাবেক স্পিকার তথা মেঘালয়ের ভূমিপুত্র পিএন সাংমাকে ৭১ শতাংশের বেশি ভোটে হারিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে ইউপিএ প্রার্থী হিসাবে প্রণব বাবু নির্বাচিত হন। এই বছর ২৫ জুলাই রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণ করেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ১৯৫৭ সালের ১৩ জুলাই প্রণব মুখোপাধ্যায় শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের দুই পুত্র ও এক কন্যা। প্রণব বাবু অবসরকালে বই পড়তে, বাগান পরিচর্যা করতে ও গান শুনতে ভালবাসতেন।
২০১০ সালে বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের দৈনিক সংবাদপত্র এমার্জিং মার্কেটস তাঁকে 'ফাইনান্স মিনিস্টার অফ দ্য ইয়ার ফর এশিয়া' পুরস্কার দিয়েছিল। এই বছরই ডিসেম্বর মাসে, দ্য ব্যাঙ্কার পত্রিকা তাঁকে “ফাইনান্স মিনিস্টার অফ দ্য ইয়াস” সম্মানে ভূষিত করে। ২০১১ সালে উলভারহ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডক্টর অফ লেটারস ডিগ্রি দেয়। ২০১৩ সালের ৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডক্টরেট অফ ল ডিগ্রি দেয়। এই বছর ৫ মার্চ তিনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার “বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা” পুরষ্কারে পুরষ্কৃত করা হয়। সালের ১৩ মার্চ মরিশাস বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডক্টর অফ ল সম্মান দেয়। ২৫ জানুয়ারি ২০১৯ সালে প্রণব মুখোপাধ্যায়'কে ভারতরত্ন পুরস্কারে সম্মানিত হন। আজ ৩১ আগস্ট এই মহান বাঙালিকে আমরা হারালাম।