বিবস্বান বসু্: পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম দফায় ৩০টি আসনের মধ্যে ২৬টি আর দু’দফা মিলিয়ে মোট ৬০টি আসনের মধ্যে ৫০টি বিজেপি ঘরে তুলবে বলে দাবি করেছেন অমিত শাহ৷ ২০০-র বেশি আসন জয় করে বাংলায় সরকার গড়ার ডাক দেওয়া এই প্রবল পরাক্রমশালী বিজেপি নেতার আরও দাবি, উত্তরবঙ্গের ৫০টি আসনের (বাস্তবে যদিও ৫৪টি) মধ্যে ৫০টিতেই ফুটবে পদ্মফুল৷ অমিত শাহের অঙ্ক অনুযায়ী, বিজেপির ঘরে একশো আসন ঢুকেই গিয়েছে৷ বাকি ছ’দফার পর ‘সোনার বাংলা’ গড়া শুধুই সময়ের অপেক্ষা৷ বিজেপির সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড হিসেবে অমিত শাহ এই প্রত্যয় দেখাতেই পারেন, নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস চারিয়ে দিয়ে দলকে উজ্জীবিত করতেই পারেন৷ কিন্তু বাস্তবও কি সেটাই বলছে? নাকি এটা গেরুয়া শিবিরের সেই সুচারু ‘পারসেপশন পলিটিক্স’? ধারণার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করে মানুষের মনে বিশ্বাসের ভিত তৈরি করা? বিজেপিই আসছে বাংলার ক্ষমতায়, একথা জনমানসে গেঁথে দিয়ে পৌঁছে যাওয়া মসনদ দখলের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে?
বাংলার ভোটের ইতিহাস বলছে, যতই অশান্তি হোক না কেন, বিরোধীরা যতই অভিযোগের ঝড় তুলুক না কেন, সাধারণ ভাবে শাসক দলের বুলি থাকে একই— কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া নির্বাচন মোটের ওপর শান্তিপূর্ণ৷ কিন্তু এবার সেখানেই উলটপুরাণ৷ দু’দফার নির্বাচন শেষে তৃণমূল বেশ কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগের আঙুল তুললেও, নির্বাচন কমিশনকে কাঠগড়ায় তুললেও, প্রধান বিরোধী দলের পরিসর দখল করা বিজেপি যেমন ভোট নিয়ে খুশি, তেমনই সন্তুষ্ট কমিশনের ভূমিকায়৷ খোদ অমিত শাহ পর্যন্ত দরাজ শংসাপত্র দিয়েছেন, নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, নন্দীগ্রাম দিদিকে জবাব দিয়ে দিয়েছে৷ কিন্তু কেন এই ১৮০ ডিগ্রি বিপরীত ছবি? সত্যিই কি বিজেপি এতটা খুশি ভোটপ্রক্রিয়ায়? নাকি এটাও ভোট রাজনীতির কৌশল? কমিশনের ভূমিকায় সন্তোষপ্রকাশ করে কি বঙ্গ দখলের যুদ্ধে ‘ফিল গুড ফ্যাক্টর’ আমদানি করতে চাইছে গেরুয়া শিবির? বার্তা দিতে চাইছে ‘অল ইজ ওয়েল’?
একথা অনস্বীকার্য যে, তৃণমূল কংগ্রেসের গত দশ বছরের শাসনের ফলস্বরূপ উদ্ভূত ক্ষোভের পাঁকে গোটা বাংলাজুড়েই পদ্ম ফুটেছে৷ যথেষ্ট প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া রয়েছে জনগণের মধ্যে৷ সেই সঙ্গে ২০১৪ বা ২০১৯ সালের মতো না-হলেও, রয়েছে মোদি-হাওয়াও৷ তার পরও অবশ্য রাজনীতির কারবারিরা জোর দিয়ে বলতে পারছেন না, বাংলায় পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী৷ তার কারণ হিসেবে একদিকে যেমন রয়েছে বিজেপির সাংগঠনিক দুর্বলতা ও তাদের বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতি, তেমনই উলটো দিকে রয়েছে উন্নয়নকে সামনে রেখে ভোটে লড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি এখনও বড় অংশের মানুষের ভরসা৷ বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের হিসেবে এটা নেই, তা নয়৷ আর তার জন্যই প্রয়োজন পারসেপশন পলিটিক্সের৷ তারাই ক্ষমতায় আসছে, মানুষের মনে এই ধারণা গড়ে দিতে পারলে, নিঃসন্দেহেই অনেক সহজ হয়ে যায় পলিটিক্যাল মার্কেটিং৷
বিজেপি যে এই খেলার অনেক পুরনো ও চৌখস খিলাড়ি, সেকথা বলাই বাহুল্য৷ ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদিকে কার্যত ‘মসিহা’ হিসেবে তুলে ধরে এই ধারণার রাজনীতিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল তারা৷ দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে তোলা দুর্নীতির আওয়াজ প্রোথিত করে দিতে পেরেছিল জনতার মনের গভীরে৷ তার পরের সাত বছরে রাম-রাজনীতির বাইরে তেমন কোনও সাফল্য ছাড়াও (নোটবন্দি আর জিএসটিকে সাফল্য না ব্যর্থতা কী ধরবেন, সেটা পাঠকের বিচার্য) যে ‘মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’ স্লোগান কম-বেশি ডিভিডেন্ড দিচ্ছে, সেটাও ওই পারসেপশন পলিটিক্সেরই অঙ্গ৷
১৯৮৯-এ শুধুমাত্র বোফর্স ইস্যুতে ভর করে ৪১৬ আসন পেয়ে নির্বাচিত একটা সরকারকে ফেলে দেওয়া যেমন পারসেপশন পলিটিক্সের একটা বড় উদাহরণ, তেমনই বিজেপিও জানে গোয়েবলসীয় ঢঙে প্রচার চালিয়ে যেতে পারলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লাভের গুড় ঘরে ওঠে ষোল আনার ওপর আঠেরো আনা৷ এখন প্রশ্ন, বাংলার গদি দখলের ‘নাউ অর নেভার’ যুদ্ধে সেই ফর্মুলাই কি প্রয়োগ করছে পদ্মশিবির? অর্থের প্রবল আস্ফালনকে পুঁজি করে সংবাদমাধ্যম-সমাজ মাধ্যমে বিজ্ঞাপনী প্রচারে ঢেউ তোলাই হোক বা নেতৃত্বের সদর্প ঘোষণার হাত ধরেই হোক, ধারণার রাজনীতির বিপণন করেই কি বাকি ছ’দফায় বঙ্গ-মনকে গেরুয়ায় রাঙিয়ে দিতে চাইছে বিজেপি?