টোটো জনজাতির ছাত্রীদের স্কুলমুখো করে জাতীয় পুরস্কার পেলেন বাংলার শিক্ষিকা

২০০৮ সালে যখন শিক্ষিকা মিশা ঘোষাল আলিপুরদুয়ারের ধানিরাম টোটো উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে যোগ দেন, তখন থেকেই সভ্য সমাজের সঙ্গে এই উপজাতি সম্প্রদায়ের যোগাযোগ গড়ে ওঠে। তাদের পৃথিবীর বাইরে বেরিয়ে এক অন্য পৃথিবীর সন্ধান পান এই সম্প্রদায়ের মেয়েরা। আগে খুব ছোট বেলায় বিয়ে দেওয়া হত মেয়েদের, ফলে কম বয়সে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে একাধিক মেয়েরাই মারা যেত। শিক্ষিকা মিশা দেবী বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে বলেছেন, অনুরোধ করেছেন অল্প বয়সে বিয়ে না দিতে। পাশাপাশি পড়াশোনা করার গুরুত্ব অনুধাবন করিয়েছেন।

 

আলিপুরদুয়ার: এ এক অনন্য কাহিনী। মূলত আলিপুরদুয়ারে বসবাস করা হাতে গোনা একটি সম্প্রদায়, যাদের অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্তির দিকে৷  টোটো সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ে বাল্য বিবাহ ও চিকিৎসক সংক্রান্ত নানান সমস্যা রয়েছে৷ মাদক সেবন নিত্য অভ্যাস৷ মেয়েদের পড়াশোনা করানোর কথা তারা চিন্তাও করতে পারেন না তাঁরা৷ সেখানেই এক শিক্ষিকা তাঁদের জীবনে এনেছেন আমূল পরিবর্তন। মেয়েদের ছোটবেলায় বিয়ে দিতে মানা করে তাদের স্কুলমুখো করেছেন। বর্তমানে একাধিক ছাত্রীর মা নিজে তাঁর মেয়েকে স্কুলে ছাড়তে আসেন। এই অসাধারণ প্রচেষ্টাকে কুর্নিশ জানিয়েছেন দেশের রাষ্ট্রপতি। শিক্ষক দিবসে এই শিক্ষিকাকে জাতীয় পুরষ্কার দিয়ে সম্মান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি রমানাথ কোভিন্দ৷

বর্তমানে আলিপুরদুয়ার ছাড়া এই টোটো সম্প্রদায়কে তেমন কোথাও আর খুঁজে পাওয়া যায় না। মেয়েরা করবে পড়াশোনা? এই চিন্তাধারা বিশ শতকে দাঁড়িয়েও তাঁরা কখনও ভাবতে পারেননি৷ বলা ভালো সুযোগ পৌঁছে দেওয়া হয়নি৷ কিন্তু ২০০৮ সালে যখন শিক্ষিকা মিশা ঘোষাল আলিপুরদুয়ারের ধানিরাম টোটো উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে যোগ দেন, তখন থেকেই সভ্য সমাজের সঙ্গে এই উপজাতি সম্প্রদায়ের যোগাযোগ গড়ে ওঠে। তাদের পৃথিবীর বাইরে বেরিয়ে এক অন্য পৃথিবীর সন্ধান পান এই সম্প্রদায়ের মেয়েরা। আগে খুব ছোট বেলায় বিয়ে দেওয়া হত মেয়েদের, ফলে কম বয়সে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটত৷ শিক্ষিকা মিশা দেবী বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে বলেছেন, অনুরোধ করেছেন অল্প বয়সে বিয়ে না দিতে। পাশাপাশি পড়াশোনা করার গুরুত্ব অনুধাবন করিয়েছেন। মিশা দেবীর কথায়, ‘‘আমি যখন প্রথম এই স্কুলে আসি তখন ছাত্রীর সংখ্যায় ছিল খুবই কম। তখন মাধ্যমিক পাশের সংখ্যাটাও অনেক কম ছিল। আর যারা পাশ করত, তারপর তারা আর পড়াশোনা করত না। বাড়ি থেকে বিয়ে দেওয়া হত।’’

এই স্কুলের এক ছাত্রী রিতা টোটো বর্তমানে স্নাতক পাশ করে সরকারি চাকরি করছে। মিশা দেবী জানিয়েছেন, তাঁর স্কুলের ৯৯ শতাংশ ছাত্রী তফশিলি সম্প্রদায়ের৷ যাদের মধ্যে আবার ৬০ শতাংশই টোটো সম্প্রদায়ের। তিনি আরও জানান, পাহাড়ি পথ পেরিয়ে স্কুলে আসতে সমস্যা হত, সেই কারণে অনেকেই স্কুলের চৌকাঠ পার করত না। এখন পশ্চিমবঙ্গ অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতর সেই সমস্ত পড়ুয়াদের জন্যে স্কুলের কাছে হোস্টেল তৈরি করে দিয়েছে। ফলে বর্তমানে অনেক বেশি সংখ্যক ছাত্রী পড়াশোনা করতে পারছে। সরকারের এই পদক্ষেপকে মিশা দেবী কুর্নিশ জানিয়েছেন।

মিশা দেবীর কথায়, তিনি মেয়েদের মধ্যে শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন তাঁর মায়ের কাছ থেকেই। মিশা দেবী জানান, তাঁর মায়ের ইচ্ছাতে তিনি লেডি ব্রাবোর্ন কলেজে এসে পড়াশোনা করেন। এরপর এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়ে আলিপুরদুয়ার জেলাকে বেছে নিয়েছেন নিজের কর্মক্ষেত্র হিসাবে। প্রথম থেকেই মিশা দেবী ভেবেছিলেন এখানকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটাবেন তিনি। আর সেই স্বপ্ন আজ বাস্তব রূপ পাচ্ছে। তাই খোদ রাষ্ট্রপতিও তাঁর এই অনন্য প্রচেষ্টাকে কুর্নিশ জানালেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × 1 =