বিবস্বান বসু: ভোটের দফা গড়ানো শুরু হতেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে তির ছুড়তে শুরু করেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তার পর ভোটের চাকা গত এগিয়েছে, ততই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আক্রমণের মাত্রা৷ কেন্দ্রীয় বাহিনী রাজ্যের শাসক দলকে ভোটদানে বাধা দিচ্ছে, বিজেপিকে ভোট দেওয়ার জন্য প্রভাবিত করছে এহেন চাঞ্চল্যকর অভিযোগ তুলে নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি সিআরপিএফকেও পক্ষপাতিত্বের কাঠগড়ায় তুলেছেন তৃণমূল নেত্রী৷ কমিশন এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী দুইই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের অঙ্গুলিহেলনে চলছে বলে দাবি করে, ভোটারদের উদ্দেশে তাঁর নিদান, বাহিনী যদি তাঁদের হেনস্থা করে, তা হলে যেন বাহিনীকে ঘেরাও করে রাখেন তাঁরা৷ তবে ‘বিজেপি-সিআরপিএফ’কে আক্রমণ করাই শুধু নয়, বুধবার কোচবিহারের জনসভা থেকে পুলিশের দিকে আঙুল তুলেও বিস্ফোরক অভিযোগ করেছেন মমতা৷
তৃণমূল নেত্রীর কথায়, ভোটের সময় পুলিশ বিজেপি হয়ে যায়৷ তাই ওঁদের বিশ্বাস করবেন না৷ ‘ছোট পুলিশ’দের কোনও দোষ না-দেখলেও, ‘পুলিশের নেতারা আন্ডারস্ট্যান্ডিং করে বসে আছে’ বলে দাবি মমতার৷ আরামবাগের তৃণমূল প্রার্থী সুজাতা মণ্ডলের আক্রান্ত হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আরামবাগের ওসির দৌড়ও দেখে নিয়েছি৷ সুতরাং, আমরাও কিন্তু লক্ষ্য রাখব কে কী করছেন৷’ মমতার বক্তব্য, তৃণমূল শান্তিপূর্ণ ভোট চায়৷ পুলিশও নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করুক৷ কিন্তু রাজনৈতিক মহলের কৌতূহল, ভোট যখন প্রায় মধ্যগগনে, তখন কেন এমন সাড়া ফেলে দেওয়া অভিযোগ করলেন তৃণমূল নেত্রী? মুখ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি তিনি নিজেই যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী, সেখানে কেন পুলিশের গায়েও বিজেপির স্ট্যাম্প মারতে হচ্ছে তাঁকে? একি নেহাতই ভোটের ‘খেলা’র ঘুঁটি সাজানো নাকি এর পরিণাম সুদূরপ্রসারী? জনমানসে এই অবিশ্বাস তৈরির চেষ্টা মোটের ওপর পুলিশকর্মীদের মনোবল ভেঙে দেবে না তো? সর্বোপরি, পুলিশকে চাঁদমারি করে তাঁর এই আক্রমণের পরিণতিতে যদি রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে, তা হলে তার দায় নেবেন তো তৃণমূল সুপ্রিমো?
ইতিহাস বলছে, ভোটের সময় কেন্দ্রীয় বাহিনী বা পুলিশের ওপর ‘শাসক’ মমতার এই চাপ বাড়ানোর কৌশল নতুন কিছু নয়৷ ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনেও পুলিশকে নিশানা করেছিলেন তিনি৷ আর তার পর ক্ষমতায় ফিরে নিচু থেকে উঁচু- ঢালাও বদলি আর ‘কম্পালসরি ওয়েটিং’৷ এবার নতুন বলতে একেবারে বিজেপির তকমা সেঁটে দেওয়া৷ আর সেটা যে মমতা স্রেফ আবেগের বশে করেছেন, হিসেব কষে নয়, তা ভাবলে বাস করা হবে মূর্খামির স্বর্গে৷ প্রথমত তিনি একেবারে নিচুতলার পুলিশকে আক্রমণ করেননি, করেছেন পুলিশের নেতাদের৷ এখন পুলিশের নেতা মানে উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্তারা নাকি পুলিশ সংগঠনের নেতারা, তা স্পষ্ট না-হলেও, এটা স্পষ্ট, তিন দফা ভোট হয়ে যাওয়ার পরও বাকি পাঁচ দফায় পুলিশকে ‘কী জানি কী হয়’-এর দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ফেলে দিয়ে চাপের মধ্যে রাখারই কৌশল এই আক্রমণ৷ মাঠে নেমে কাজ করা বড় অংশের ‘ছোট’ পুলিশকে অভয় দেওয়ার পাশাপাশি সূক্ষ্মভাবে স্মৃতিতে টোকা দিয়ে দেওয়া, তিনি যদি তৃতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হন, তা হলে হতেই পারে ২০১৬-র ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি৷ তিনি যে সব ‘লক্ষ্য’ রাখছেন৷
মমতা জানেন, আদর্শ আচরণবিধি লাগু হওয়া ইস্তক পুলিশ-প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের অধীনে৷ আর এখন তিনি মুখ্যমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নন, বরং এক্কেবারে পুরোদস্তুর রাজনীতিক, যাঁর কাঁধে ভর করেই তৃতীয়বারের জন্য বঙ্গ-দখলের যুদ্ধে নেমেছে তৃণমূল কংগ্রেস৷ আর রণে যেহেতু কোনও অন্যায় নেই, তাই মমতাও খেলছেন ঝোড়ো মেজাজে৷ তাঁর চড়া সুরের আক্রমণ নিয়ে কমিশনের কোর্টে কাটাছেঁড়া হলেও, জনতার আদালতে তা যদি হিট হয়ে যায়, তা হলে যে কেল্লা ফতে, তা মমতার চেয়ে ভালো কেউ জানেন না৷ তাঁর তোপে যদি পুলিশের মনোবল বা রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েও বা, তা হলেও তার দায় মমতার নেই, বরং তা এখন দায় নির্বাচন কমিশনেরই৷ এটাও তৃণমূল নেত্রী বিলক্ষণ জানেন, আইন-শৃঙ্খলা যদি সত্যিই প্রশ্নের মুখে পড়ে যায় আর তার জন্য কমিশন তাঁকে হাঁড়িকাঠে চড়ায়, তা হলে সহানুভূতির ঝড় তাঁর পক্ষে ওঠার সম্ভাবনা ষোল আনার ওপর আঠেরো আনা৷ অতএব মমতার হারানোর কিছু নেই, জয় করার জন্য আছে শুধু নবান্ন৷