তিরুবনন্তপুরম: লকডাউন বদলে দিয়েছে বহু মানুষের জীবন৷ কেউ কর্মহীন হয়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সামিল হয়েছেন, কেউ আবার সময়ের সদ্ব্যবহার করে নিজের অধরা ইচ্ছা পূরণে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন৷ করোনা কালে জীবন যখন আমাদের অন্য পাঠ দিচ্ছে তখন নিজের জীবনকে ভিন্নভাবে সাজালেন কেরলের তিরুবনন্তপুরমের বাসিন্দা সফি বিক্রমণ৷
আরও পড়ুন- বিমান নামার পর কোভিড টেস্ট, পঞ্জাবে পজিটিভ ১২৫
লকডাউনের মধ্যে অফুরন্ত সময় হাতে পেয়েছিলেন সফি৷ সেই সময় অপচয় না করে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিলেন পড়াশোনায়৷ এমনকী এর জন্য চাকরিও ছেড়ে দেন তিনি৷ এই সময়ের মধ্যে ১৪৫টিরও বেশি কোর্স শেষ করেন পঞ্চাশোর্ধ সফি৷ বিদেশের তাবড় তাবড় নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি হাসিল করেছেন তিনি৷ এর মধ্যে রয়েছে ইয়েল, প্রিন্সটন, কলম্বিয়া, স্ট্যান্ডফোর্ড-সহ আইভি লিগের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়৷ সব মিলিয়ে প্রায় ১৩০টিরও বেশি সংশাপত্র লাভ করেছেন তিনি৷ লকডাউনে ভর্চুয়াল মাধ্যমকে হাতিয়ার করে ১৬টি দেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন কোর্স করেছেন সফি৷
নতুন কিছু শেখা বা জানার আগ্রহ তাঁর বরাবরের৷ কিন্তু দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে গিয়ে কাজের চাপে সেই সখ চাপা পড়ে গিয়েছিল৷ লকডাউন তাঁকে নতুন করে ইচ্ছে পূরণের সুযোগ এনে দেয়৷ এমনকী তিরুঅনন্তপুরমে একটি নামজাদা বিদেশি মুদ্রা বিনিময় সংস্থার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজারের পদ থেকেই ইস্তফা দেন পড়াশোনার নেশায় বুঁদ সফি৷
২০২০ সালের ২৫ মার্চ, করোনার সংক্রমণ রুখতে দেশ জুড়ে জারি হয় লকডাউন৷ সেই সময় বাড়িয়ে থাকার সুযোগ পেয়ে নতুন নতুন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন সফি। প্রথমে কিছুটা শখ পূরণের তাগিদেই অনলাইনে বিভিন্ন কোর্সে যোগ দেন তিনি৷ ২০২০ সালের জুলাই৷ তখন দেশে লকডাউন চলছে৷ আমেরিকার কোরসেরা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র একাধিক কোর্সের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকেন সফি। বলে রাখি, কোরসেরা হল আমেরিকার একটি অনলাইন সংস্থা৷ যারা বিভিন্ন ধরনের কোর্স করিয়ে থাকে। তবে সেগুলো বেশির ভাগই মেডিক্যাল সেক্টরের। ধীরে ধীরে একাধিক বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন সফি৷
বিষয়টা অতটাও সহজ ছিল না৷ ছিল ভীষণ রকম চ্যালেঞ্জিং৷ এই বয়সে এসে নতুন নতুন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে গোড়ার দিকে বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল সফিকে। তিনি বলেন, ‘‘প্রথমে আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি কোর্স শুরু করি। প্রথমে সব কিছু এলোমেলো লাগছিল৷ খুবই কষ্টকর মনে হয়েছিল। প্রথম কোর্সটা শেষ করতে বেশ সমস্যার মধ্যে পড়েছিলাম।’’
তবে নতুন করে পড়াশোনা শুরু করার আগে বিষয় নিয়ে বিশেষ একটা বাছাবাছি করেননি সফি। হাতের কাছে যে কোর্স পেয়েছেন, সেটাই শুরু করে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথমে বিশেষ বাছাবাছি না করে যে বিষয়টা ভাল লেগেছিল, সেটাই শিখতে শুরু করেছিলাম।’’ কিন্তু উচ্চপদে কর্মরত থাকায় সফিকে অফিসেরও গুরু দায়িত্ব সামলাতে হত। অফিসের দায়িত্ব সামলে এতগুলো কোর্সের পড়াশোনা ঠিকমতো করে উঠতে পারছিলেন না সোফি৷ তাই মনস্থ করেন চাকরি ছাড়বেন৷ যেমন ভাবা তেমন কাজ৷ কিন্তু তখন চাকরি করতেন, তখন কী ভাবে সামলাতেন সবকিছু? সফি বলেন, ‘‘অফিস থেকে ফিরে সন্ধেবেলা থেকে পড়াশোনা করতে বসে যেতাম। সন্ধ্যে ৬টা থেকে পরের দিন ভোর ৪টে পর্যন্ত একটানা পড়াশোনা করেছি৷ তিন-চার মাস দিনে মাত্র দু’ঘণ্টা করে ঘুমতে পেরেছি৷ কোনও কোনও দিন ঘুমটাও হতো না৷’’ মূলত বিদেশের সঙ্গে দেশের সময়ের ফারাকের জন্যই রাত জেগে অনলাইন ক্লাস করতে হত তাঁকে৷ থাকায় পড়াশোনার নেশায় ঠিক মতো ঘুমোতে পারতেন না বলেও জানিয়েছেন সফি।
তিনি জানান, এক সময় চাকরির কাজে তাঁকে দক্ষিণ ভারতে, বিশেষ করে তামিলনাড়ুতে যেতে হত। এদিকে লকডাউনের জেরে ছিল বিস্তর বিধিনিষেধ৷ সবদিক ভেবে স্থির করেন পড়াশোনার স্বার্থে চাকরি ছাড়বেন তিনি। এখনও পর্যন্ত মেডিসিন, ফাইনান্স, রোবোটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ফরেন্সিক এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি-সহ একগুচ্ছ কোর্স শেষ করে ফেলেছেন সফি। আপাতত একসঙ্গে ২২টি কোর্সের পড়াশোনা করছেন তিনি৷ কিন্তু কী ভাবে একসঙ্গে একগুলো কোর্সের চাপ সামলান সফি? তিনি জানান, কিছু কোর্স রয়েছেন দু’দিনের৷ কিছু কোর্স আবার দুই মাসের৷ ফলে এক সময় একসঙ্গে ২০টি কোর্সও করেছেন তিনি৷
সফির এই কাজে গর্বিত তাঁর পরিবার৷ যতই কাজের চাপ থাকুক বা সংসারের, অনলাইনে একটা লেকচারও মিস করেন না তিনি৷ বিশ্বের নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করা তাঁর কাছে স্বপ্ন পূরণের সামিল৷ তাঁ কথায়, ‘‘আমার সামনে যেন নতুন দরজা খুলে গিয়েছে৷’’