রাঁচি: সেপ্টেম্বরের তপ্ত দুপুর৷ প্রথর রৌদ্রে তখন ফুটিফাটা চাইবাসর মাটি৷ এমনই এক দুপুরে ঝাড়খন্ডের পশ্চিম সিংভূমের এই ছোট্ট শহরে পৌঁছন নবনিযুক্ত জেলা উন্নয়ন অফিসার আদিত্য রঞ্জন৷ আদিবাসী অধ্যুষিত এই অঞ্চলে পৌঁছেই প্রাথমিক স্কুলগুলিতে তৃণমূল স্তরে সার্ভে শুরু করেন তিনি৷ বোকারোতে বেড়ে ওঠা আদিত্যবাবু এই জেলার, বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রামগুলির শিক্ষার হাল সম্পর্কে অনেকটাই অবগত ছিলেন৷ কিন্তু তিনি যতটুকু অনুমান করেছিলেন, তার চেয়ে বাস্তবটা ছিল অনেক বেশি ভয়ঙ্কর৷
তিনি যখন গ্রামে পৌঁছন, তাঁকে অনাকাঙ্খিতভাবে তাঁকে স্বাগত জানায় ভেঙে পড়ে অঙ্গনওয়াড়ি স্কুল আর নিরাশায় ভরা আসহায় দরিদ্র শিশুগুলির করুন চোখ৷ নেই কোনও শিক্ষক৷ স্কুল বলতে শুধুই মিড ডে মিল৷ জেলার শতাধিক অঙ্গনওয়াড়ি স্কুলগুলির চালচিত্র ছিল একই৷ যা তাঁকে চরম হতাশ করে৷ এই অবস্থায় কী পদক্ষেপ করবেন তিনি? পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে প্রায় দু’দিন সময় লেগে গিয়েছিল তাঁর৷
সালটা ছিল ২০১৮৷ রাজ্যে মডেল অঙ্গনওয়াড়ি গড়ে তুলতে প্রতিজ্ঞবদ্ধ হন আদিত্যবাবু৷ স্বপ্ন পূরণে তিনি বেছে নেন ভগ্ন দশায় পড়ে থাকা গীতিলিপি অঙ্গলওয়াড়িকে৷ মডেল অঙ্গনওয়াড়ি গড়তে নিজের বেতনের একটি বড় অংশ ব্যয় করতেও পিছপা হননি তিনি৷ কয়েক মাসের মধ্যেই প্লাস্টার, রং , শৌচাগার থেকে শুরু করে গোটা স্কুল বাড়িটি সাজিয়ে ফেলেন এই আইএএস অফিসার৷ এর পর গোটা এলাকায় অঙ্গনওয়াড়ি ব্যাবস্থায় বিপ্লব ঘটান তিনি৷ পশ্চিম সিংভূম জেলার ৬৫০টি অঙ্গনওয়াড়ি স্কুলে উল্লেখযোগ্য পরিবর্ত আনেন আদিত্যবাবু৷ এখানেই শেষ নয়, ভ্রাম্যমান সায়েন্স ল্যাবরেটরি, ডিজিটাল লিটারেসি ওয়ার্কশপ এবং একাধিক হেল্থ সেন্টার তিনি গড়ে তোলেন৷
অন্ধকারে পড়ে থাকা শিশুগুলির কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন প্রথম থেকেই দেখতেন ২০১৫ ব্যাচের এই আইএএস অফিসার৷ তাঁর প্রথম পোস্টিং ছিল দেওঘরে৷ সেখানে বিনা পয়সায় ছোটদের পড়ানো শুরু করেছিলেন তিনি৷ পড়াশোনার সুযোগ না পাওয়া ছেলেমেয়েগুলোর কাছে তিনিই ছিলেন ভগবানের দূত৷ এর পর পশ্চিম সিংভূমে পোস্টিং হয় তাঁর৷ কিন্তু সেখানকার বাস্তবটা ছিল খুবই কঠিন৷ শিক্ষার নামে ছিল শুধুই অন্ধকার৷ অঙ্গনওয়াড়ির সেবিকা ও সহায়িকারদের কাজে ছিল প্রবল অবহেলার ছাপ৷ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে তিতলি টিচার ট্রেনিং ইন্সটিটিউট থেকে তাঁদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন আদিত্যবাবু৷ এর পরই ভোল বদলাতে শুরু করে অঙ্গনওয়াড়ি স্কুলগুলির৷ আদিত্যবাবু বলেন, এই সেবিকা ও সহায়িকারা এখন অনেক বেশি সচেতন৷ পড়াশোনা থেকে শুরু করে শিশুদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সব দিকে সযত্নে নিজেদের কর্তব্য পালন করে চলেছেন দায়িত্বের সঙ্গে৷
ছাত্রছাত্রীরাও এখন আর বাড়ির পোশাক পরে স্কুলে আসে না৷ ওদের দেওয়া হয়েছে স্কুলের ইউনিফর্ম৷ দেওয়া হয়েছে নেইল কাটার, চিরুনি, টিস্যু পেপার, সাবান সহ যাবতীয় স্যানিটেশন কিটস৷ শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই পড়ুয়াদের হাতে তুলে দেওয়া হয় নতুন বই-খাতা-পেনসিল৷ দেওয়া হয় স্টেশনারি দ্রব্য এবং শিক্ষামূল খেলনা৷ গীতিলিপির ছেলেমেয়েদের শেখানো হয় তাঁদের জন্মভূমির কথা৷ দেওয়া হয় রাজ্যের ইতিহাস আর সংস্কৃতির পাঠ৷ আদিত্যবাবুর হাত ধরে কারিগড়ি শিক্ষার পাঠও আজ সহজেই পায় একদা অন্ধকারে ডুবে থাকা শিশুর দল৷