কলকাতা: সিনেমার প্রসঙ্গ উঠলেই সবার আগে মনে আসে নায়ক-নায়িকাদের কথা। কারণ তাঁরা একটা ছবির মুখ্য চরিত্র৷ কিন্তু পার্শ্ব চরিত্রগুলো না থাকলে, কোনও ছবিই সমাজের প্রকৃত দর্পন হয়ে উঠতে পারত না৷ হিরো-হিরোইনদের পাশাপাশি ছবিতে চরিত্রাভিনেতাদেরও অবদানও কম নয়। যদিও ক’জনই বা তাঁদের মনে রাখে৷ তবে চিত্রনাট্যে যাদের উপস্থিতি ছাড়া একটি পারিবারিক ছবি সম্পূর্ণ হয় না, তাঁরা হলেন পর্দার বাবা। বাংলা ছায়াছবির বাবার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন একের পর এক লেজেন্ডারি অভিনেতারা৷ তাঁদের কিছু আইকনিক চরিত্রগুলিই আজ তুলে ধরব৷ তবে বলে রাখি, এঁদের অনেকেই যৌবনে নায়কের ভূমিকাতেও অভিনয় করেছেন।
জহর গঙ্গোপাধ্যায়- বাংলা ছবিতে জহর গঙ্গোপাধ্যায় এক উল্লেৎযোগ্য নাম৷ একসময় নায়কের ভূমিকায় পর্দা কাঁপিয়েছেন তিনি। রোমান্টিক হাস্যকৌতুক ঘরানার ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’-এ জহর-কানন (দেবী) আইকনিক হিট। পরবর্তীকালে তিনি অবশ্য বাবার ভূমিকায় অনেক বেশি অভিনয় করেছেন। সহজ-সরল মধ্যবিত্ত বাঙালি পিতার চরিত্রে জহর গঙ্গোপাধ্যায়ের জুড়ি মেলা ভার৷
বিজয় বসুর ‘আরোগ্য নিকেতন’ ছবিতে সন্ধ্যা রায়ের জমিদার পিতার ভূমিকায় জহর ছিলেন অনবদ্য। যাঁকে তাড়া করে বেরাত মৃত্যুভয়৷ গ্রামের খ্যাতিমান আয়ুর্বেদ চিকিৎসক বিকাশ রায় তাঁর নাড়ি দেখে নিদান দিয়েছিলেন তাঁর আয়ু আর কিছু দিনের৷ সেইসময়ে গ্রামে আসেন মেডিসিন নিয়ে পাশ করা ডাক্তার শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। যিনি সম্পর্কে বিকাশ রায়ের নাতি, যা বিকাশ রায় নিজেই জানেন না। শুভেন্দু জহরকে পুরোপুরি সুস্থ করে তুলে নস্যাৎ করেছিলেন বিকাশ রায়ের নিদান।
ছবি বিশ্বাস– বাংলা ছবির অপর আইকনিক পিতা হলেন ছবি বিশ্বাস৷ তাঁর রাশভারী জমিদারি দাপট ঘরে ঘরে নকল করতেন বাবারা৷ ছবি বিশ্বাস একসময় নায়কের চরিত্রে অভিনয় করলেও উত্তম-সুচিত্রার যুগ থেকে তিনিই ছিলেন বাংলা ছবির আল্টিমেট বাবা। উত্তম-সুচিত্রা জুটির বেশিরভাগ ছবিতেই বাবার ভূমিকায় দেখা যেত ছবি বিশ্বাস আর পাহাড়ি সান্যালকে৷ কখনও তাঁরা দাপুটে শ্বশুর৷ ‘শশীবাবুর সংসার’ ছবিতে অমর হয়ে থাকবে ছবি বিশ্বাস৷ ভোলা যাবে না ‘সপ্তপদী’৷ তবে আরও একটা ছবির কথা না বললেই নয়৷ সেটি কাবুলিওয়ালা৷ ওই ছবিতে তাঁর সংলাপ, “লেকিন খোঁকি তুমি শ্বশুরবাড়ি যাবে না, হামাকে ছেড়ে কোত্থাও যাবে না,” আজও দর্শকের মন ছুঁয়ে যায়৷
পাহাড়ি সান্যাল- বাংলা ছবিতে স্নেহমাখা পিতার ভূমিকায় অপ্রতিরোধ্য পাহাড়ি সান্যাল৷ তিনিও ছেলে মেয়েকে শাসন করতেন৷ কিন্তু সেটা ছবি বিশ্বাস বা কমল মিত্রের মতো কড়া সুরে নয়। পাহাড়ির ভিতর ছিল একটা সাহেব কালচার৷ যেমন ভালো ছিল তাঁর ইংরাজি উচ্চারণ, তেমনই ভালো গানের গলা। ‘হসপিটাল’, ‘দ্বীপ জ্বেলে যাই’, ‘সাত পাকে বাঁধা’র মতো ছবি পাহাড়ি সান্যালকে ভুলতে দেবে না৷
কমল মিত্র- বাংলা ছবির রাগি বাবা মানেই কমল মিত্র৷ তাঁর কণ্ঠস্বরই বুঝিয়ে দিত তাঁর দাপট৷ তিনি এমনই বাবা, যিনি হেঁটে গেলেও পিনড্রপ সাইলেন্স। কমল মিত্রের হাসির ছবি হাতে গোনা৷ তাঁকে পর্দায় খুব একটা হাসতেও দেখা যায়নি। তিনি পর্দার সন্তানদের মাই ডিয়ার হয়ে উঠতে পারেননি৷ বরং থেকেছেন দূরত্ব বজায় রেখে৷
কানু বন্দ্যেপাধ্যায়- বাংলা ছবিতে দারিদ্রের মুখ ছিলেন কানু বন্দ্যোপাধ্যায়৷ সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি’, ‘অপরাজিত’র হরিহর বা তপন সিনহার ‘উপহার’-এর কৃপণ বাবা, সব ছবিতেই তাঁর অভিনয়ে ফুটে উঠেছে অসহনীয় দারিদ্র্য-যন্ত্রণা৷ ‘আলো আমার আলো’তে সুচিত্রা সেনের দরিদ্র বাবা কানুর কথা ভুলবে না বাঙালি৷
উৎপল দত্ত- মজাদার বাবার চরিত্রে বহুবার ধরা দিয়েছেন উৎপল দত্ত৷ কিন্তু সেই সব চরিত্রকে ছাপিয়ে গিয়েছে ‘সাহেব’ ছবিতে চিন্তাগ্রস্ত পিতার চরিত্রে উৎপলের অভিনয়। যিনি বলেন “আমায় বাঁচতেই হবে বড় বৌমা, বুল্টি আর সাহেবের জন্য বাঁচতে হবে।”
কালী বন্দ্যোপাধ্যায়- যিনি ছিলেন সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিকের ছবির হিরো, তাঁকেই পিতার চরিত্রে এনে বাজিমাত করেছিলেন অঞ্জন চৌধুরী৷ তাঁর সঙ্গে জড়িয়েছিল বাঙালির আবেগ৷ ‘গুরু দক্ষিণা’ ছবিতে গুরুর চরিত্রে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়কে আজও ভুলতে পারেনি বাঙালি দর্শক৷ তিনি ওই ছবিতে শিক্ষক হলেও আমাদের কাছে শিক্ষকও তো পিতার মান৷ এর পর ‘অভাগিনী’,‘মহাজন’, ‘বিধিলিপি’, মেজো বউ, ‘ছোট বউ’-একের পর এক ছবিতে তিনি হয়ে উঠেছেন ছবির ‘বিবেক’৷
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়- এক সময় পর্দা কাঁপানো হিরো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও অভিনয় করেছেন বাবার ভূমিকায়৷ ‘শেষবেলা’, ‘আত্মীয় স্বজন’ থেকে ‘মেজো বউ’ জাত চিনিয়েছেন সৌমিত্র৷
এছাড়াও পর্দায় বাঙালির বাবা আরও আছেন৷ যাঁদের মধ্যে অন্যতম গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মল কুমার, সুপ্রিয় দত্ত, হারাধান বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় (পিএলটি)৷