কলকাতা: যাত্রাপথে মাঝে মাঝেই তাঁদের সঙ্গে দেখা হত। এক ঘেয়ে যাত্রার মধ্যে তাদের কন্ঠ খানিক স্বস্তি দিত বৈকি! হয়ত পেশাদারি সঙ্গীত শিল্পীদের মতো তাঁদের সবার কণ্ঠে আভিজাত্য থাকত না, কিন্তু তাও একটা কি দুটো স্টেশন জুড়ে তাদের কণ্ঠ ধ্বনিতে রেল লাইনের অসহ্য শব্দ থেকে খানিক রেহাই পাওয়া যেত। আবার, স্টেশনে মুখরোচক কিছু খেতে ইচ্ছে করলে ওঁদের কাছেই যেতে হত যাত্রীদের। ট্রেন থেমে গিয়েছে আজ। কণ্ঠও থেমে রয়েছে। করোনার জন্যে রেল চলাচল বন্ধ তাই থেমে গিয়েছে ওঁদের রোজগারও। সোশ্যাল ডিস্টেন্সিংয়ের চক্করে ওঁদের দু'বেলার খাবার উঠেছে আজ লাটে।
শিয়ালদহ লাইনে মহম্মদ রফি'র গান করেন বৃন্দাবন। আগে চালাতেন রিকশা, কিন্তু জীর্ণ শরীরে প্যাডেল করার ক্ষমতা একপ্রকার হারিয়েছেন তিনি। তাই আজ গান ধরেছেন। একটা বক্স বুকে ঝুলিয়ে, হাতে একটা মাইক নিয়ে ট্রেনের কামড়ায় গান গাইতেন বৃন্দাবন। মাঝে মাঝে মাইক থেকে মুখ সরিয়ে বুঝিয়ে দিতেন, লিপ দিচ্ছেন না নিজের গলাতেই গাইছেন। গান শেষ হলে যাত্রীদের কাছে হাত পাততেন। স্ত্রী অসুস্থ, চিকিৎসক বলেছেন ফল, দুধ ইত্যাদি খেতে কারণ শরীরে রক্ত নেই। অভাবের সংসারে ফল, দুধ খাওয়ার মতো বিলাসিতা করা বৃন্দাবনদের সাজে না, তাই কুলেখারা পাতাতেই রক্ত বাড়ানোর কৌশল। আসলে পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করেই তো চলতে হয় এঁদের।
স্টেশনে লিট্টির দোকান ছিল বিহারের শিউচরণ ঠকুরের। মাটির উনুন, শিকল দিয়ে বাঁধা একটা বেঞ্চ, আর মাথার ওপর একটা পলিথিন টাঙিয়ে দিব্ব্যু চলত তাঁর দোকান। কিন্তু এখন তা অতীত। স্টেশন চত্তরে অনেক দিন হল যাত্রীদের পায়ের ধুলো জমেনি। কোনও চিৎকার চেঁচামেচিও নেই। ঘুমিয়ে আছে একটা লম্বা প্লাটফর্ম। ফলে শিউচরণের পেটেও পড়েছে কোপ। লিট্টির মেজাজ অনেক দিন হল সেইভাবে তাঁর হাতে আর গড়ে ওঠেনি। ফলে এখন শিউচরণ ও বৃন্দাবনের মতো একাধিক খাটুনেরা একটু কোলাহল খুঁজতে চেষ্টা করছেন। শোনা যাচ্ছে খুব শীঘ্রই ট্রেন চালু হতে পারে। সেজে উঠছে শিয়ালদহ রেল স্টেশন সুরক্ষার পোশাকে। তাই হয়ত ভিতরে ভিতরে খানিক আশা জাগছে এই মানুষগুলির। আপনা থেকেই প্রশ্ন করছেন, ‘দাদা শুনছি নাকি ট্রেন চলবে, জানেন কিছু?’