কলকাতা: একুশের বিধানসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রাম থেকে লড়বেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যে ভোট পূর্ববর্তী রাজনৈতিক আবহে তৃণমূলের তরফে এটাই হয়তো সবচেয়ে বড় মাস্টারস্ট্রোক, বলছেন বিশেষজ্ঞরা। আর যাই হোক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নন্দীগ্রামের পুরোনো যোগকে তো অস্বীকার করা যায় না কোনোভাবেই। তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারে সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রাম এই দুই নামই অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট।
২০০৭ সালের ১৪ মার্চের ঘটনা নন্দীগ্রামকে গোটা দেশের সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু পূর্ব মেদিনীপুরের এই গ্রাম ২০০৭-এর আগেও খুব একটা অখ্যাত ছিল না। নন্দীগ্রামের মাটিতে মিশে রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন সংগ্রামের ইতিহাস। যতবার শাসকের দমননীতি কঠোর হয়ে চেপে বসেছে সাধারণ মানুষের গলায়, ততবার গর্জে উঠেছে নন্দীগ্রাম। শাসকের চোখে চোখে রেখে জবাব দিয়েছে, নন্দীগ্রাম কখনো হার মানে নি। বরং নন্দীগ্রামের মানুষের সংগ্রামের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছে সরকার। আজ, ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে আবার নতুন রূপে নতুন তাৎপর্যে উঠে আসছে সেই নন্দীগ্রামের নাম। সদ্য শাসকদল থেকে বিজেপিতে যোগ দেওয়া ‘নন্দীগ্রামের ঘরের ছেলে’ শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখোমুখি দ্বৈরথের সাক্ষী থাকতে চলেছে এই গ্রাম। গোটা বাংলায় তাই ফের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে মেদিনীপুর। নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন, নন্দীগ্রাম তার গুরুত্ব নিয়ে স্বমহিমায় বিরাজ করবে বাংলার রাজনীতিতে। আসুন দেখে নেওয়া যাক এহেন নন্দীগ্রামের কিছু চমকপ্রদ ইতিহাস।
আজ ঐতিহাসিক নন্দীগ্রাম কিন্তু একসময় পরিচিত ছিল ‘গুমগড়’ নামে। মোটামুটি খ্রীষ্টিয় ষোড়শ শতকের কাছাকাছি সময়েও মেদিনীপুরের গুমগড় এলাকা ছিল সমুদ্রের তলায়। ধীরে ধীরে সমুদ্র থেকে চর ও পরে জঙ্গল তৈরি হয়। সেই জঙ্গল কেটেই বসতি গড়ে মানুষ।স্থানীয় ইতিহাস থেকে জানা যায়, গুমগড়ের জনৈক রাজা নন্দীগোপাল রায়চৌধুরির নাম অনুসারে এই এলাকার নাম হয় নন্দীগ্রাম। স্বাধীনতা সংগ্রাম, ৪২-এর স্বদেশী আন্দোলন, ভূপাল পাণ্ডার নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলন, নন্দীগ্রাম উন্নয়ন পরিষদের আন্দোলন- কালের যাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে একের পর এক পাতা উল্টে চলে নন্দীগ্রামের ইতিহাসের।
নন্দীগ্রামের ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে উঠে আসে ১৯০৩ সালের কাহিনী। ব্রিটিশ ভারতের নন্দীগ্রাম অঞ্চলে সে সময় শুরু হয়েছিল এক বেআইনি অর্থ লগ্নির ব্যবসা। এতে গোপাল রায় নামে এক ব্যক্তির নাম জড়িয়েছিল। তিনি গ্রামের বহু মানুষকে টাকা দেওয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঠকিয়ে ছিলেন। বলা বাহুল্য, দারোগার মদতেই চলত প্রতারণা। কিন্তু গোপালের বাড়বাড়ন্ত বেশি দিন সহ্য করেননি নন্দীগ্রামের মানুষ।
প্রতারিত গ্রামবাসীরা গোপালের বাড়ি ঘেরাও করলে তাঁদের উপর লাঠিচার্জের হুকুম দেন দারোগা। এরপর ক্ষিপ্ত জনতার রোষে সেদিনের নন্দীগ্রামের পরিস্থিতি হয়ে উঠেছিল অগ্নিগর্ভ। তাড়া খেয়ে গোপাল পালালেও দারোগাকে ধরে ফেলেন মানুষ। তারপর তাকে গণ পিটুনি দিয়ে খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়। হিংসা ছড়ায় আশেপাশের এলাকাতেও। ব্রিটিশ সরকার অবশ্য ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গোপালসহ বহু মানুষকে গ্রেফতার করে। ফাঁসি হয় ৩ জনের।
যেন ১৯০৩-এর এই রক্তাক্ত নন্দীগ্রামেরই ছায়া পড়ে ২০০৭-এ। সে বছরের ১৪ মার্চ হয়তো গোটা বাংলার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বীজটা বুনে দিয়েছিল। অবসান ঘটিয়েছিল দীর্ঘ ৩৪ বছরের বামপন্থী শাসনের। ঘটনার সূত্রপাত ২০০৭-এর জানুয়ারিতে। কেমিক্যাল হাব গড়ার জন্য নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণ করতে চেয়েছিল তৎকালীন বাম সরকার। কিন্তু তার বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। তৃণমূল সমর্থিত এই কমিটির সঙ্গেই সিপিএম ক্যাডারদের ব্যাপক সংঘর্ষ বাধে, নিহত হয় ৬ জন। এরপর ১৪ মার্চ পুলিশি অভিযানে ফের রক্ত ঝরে নন্দীগ্রামের মাটিতে। আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশের নির্বিচার গুলিতে সেদিন প্রাণ হারান ১৪ জন।
আত্মবলিদান বিফলে যায় নি। দেশজোড়া সমালোচনার মুখে পিছু হটে সরকার। আর বাম সরকারের সেদিনের সেই ভুলের মাশুল লুফে নেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১সালে লাল রং মুছে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। উনিশ, কুড়ি, একুশ- শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শাসক বিরোধী সংগ্রামের ইতিহাস লিখে আসছে নন্দীগ্রামের মানুষ। ২০২১-এর নন্দীগ্রাম বিধানসভা কি সাক্ষী থাকতে চলেছে আরো এক ইতিহাসের? সেদিকেই এখন চোখ গোটা রাজ্যের।