হাবড়া: ব্যর্থতার মাঝেও ঘুরে দাঁড়ানো যায়৷ দেওয়ালে পিঠ ঠেকার পরেও এগিয়ে যাওয়া যায়৷ আশার আলো যখন নিভতে বসে, তখন ফের মশাল জ্বালানো যায়৷ না, দু’মলাটে বন্দি বুলি আওড়ানো নয়, এ এক চরম বাস্তব৷ আর সেটাই করে দেখালেন ‘এমএ ইংলিশ চায়েওয়ালি’৷
আরও পড়ুন- আশ্রয়ের জন্য বাংলাকেই কেন বেছে নিচ্ছেন জঙ্গিরা, বিস্ফোরক দাবি দিলীপের
এটা কারও নয়৷ এটা একটি চায়ের দোকানের নাম৷ সোমবার হাবড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের উপর চালু হয়েছে ‘এমএ ইংলিশ চায়েওয়ালি’৷ এই দোকানের মালকিনের নাম টুকটুকি দাস৷ বয়স ২৬৷ রবীন্দ্রভারতী মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দূরশিক্ষায় ইংরেজিতে ৬১ শতাংশ নম্বর নিয়ে স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন৷ দু’চোখে এখন একটাই স্বপ্ন একদিন এই দোকানই ব্র্যান্ড হয়ে উঠবে৷ ছোট চায়ের দোকানই হয়ে উঠবে বড় প্রতিষ্ঠান৷ কিন্তু সমাজের কাছে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন চিহ্ন হল দোকানের এই নাম৷
বাবা মায়ের স্বপ্ন ছিল, মেয়ে স্কুল শিক্ষিকা হবেন৷ কিন্তু বহু পরীক্ষা দিয়েও ভাগ্যের শিকে ছেঁড়েনি৷ এ ভাবে যে বেশি দিন চলতে পারে না, সেটা ভালোই বুঝতে পারছিলেন টুকটুকি৷ এভাবে বারবার খালি হাতে ফিরে আরও বেশি করে হতাশা ঘিরে ধরছিল তাঁকে৷ ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় হাতড়ে বেরাচ্ছিলেন তিনি৷ কিন্তু উপায় কী? শুরু হয় টুকটুকির অন্বেষণ৷
কী করবেন ভাবতে ভাবতেই একদিন ইউটিউবে খোঁজ পান মুম্বইয়ের এক শিক্ষিত যুবকের চায়ের দোকানের৷ নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার সঙ্গে মিল খাইয়েই দোকানের নাম দিয়েছিলেন ওই যুবক৷ যা ক্রমেই ব্র্যান্ড হয়ে ওঠে৷ ওই যুবকের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হন টুকটুকিও৷ কিন্তু এখানও একটি সমস্যা বাঁধে৷ তা হল পুঁজি৷ টুকটুকির বাবা পেশায় ভ্যান চালক৷ বাড়িতে ছোট একটি মুদিখানার দোকান রয়েছে তাঁর৷ সেই দোকান সামলান টুকটুকির মা দেবিকা দাস৷ দাদা থাকেন মধ্যমগ্রামে৷ অনেক স্বপ্ন নিয়ে কষ্ট করেই ছোট মেয়েকে পড়াশোনা শিখিয়েছিলেন বাবা প্রশান্ত দাস৷ আশা ছিল মেয়ে বড় হয়ে শিক্ষিকা হবেন৷ ২০১৬ সালে হাবড়া শ্রীচৈতন্য কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতক হন টুকটুকি৷ এর পর এমএ পাশ করেন৷ কিন্তু স্নাতকোত্তর মেয়ে চায়ের দোকান খুলবে? এই কথাটা মন থেকে মেনে নিতে পারছিলেন না প্রশান্ত-দেবিকা৷ তাছাড়া লোকেই বা কী বলবে? কিন্তু মেয়ের জেদের কাছে হার মানেন বাবা-মা৷
এর পরেও ফের বাধা৷ মেয়ে দেখে প্রথমে অনেকেই দোকান ভাড়া দিতে চাননি৷ পরে অবশ্য আঠারোশো টাকায় চার ফুট বাই চার ফুটের দোকান ভাড়া নিয়ে নেন টুকটুকি৷ ৫ থেকে ৩৫, বিভিন্ন দামের চা রয়েছে তাঁর দোকানে৷ একার হাতেই সব সামলাচ্ছেন তিনি৷ শুভ মহরতে অনেককে বিনা পয়সাতেও চা খাইয়েছেন৷ প্রথম দিন অনেকে উৎসাহ নিয়ে চা থেতে এসেছেন বলেও জানান তিনি৷ টুকটুকির কথায়, কোনও কাজই ছোট হয় না৷ আমার ইচ্ছে একদিন এই দোকানই ব্র্যান্ড হয়ে উঠবে৷
কিন্তু টুকটুকির এই উদ্যোগ রাজ্যে শিক্ষিত যুবকদের চাকরি না পাওয়ার যন্ত্রণাই যেন আরও একবার ফুটে উঠল৷ প্রশান্ত বাবু বলেন, এমএ পাস মেয়েকে স্টেশনের উপরে চা বানাতে দেখে মনে কষ্ট হচ্ছিলো ঠিকই৷ তবুও মেয়ে স্বনির্ভর হচ্ছে এটা দেখে ভালো লাগছে৷
টুকটুকির দোকানে চা খেতে এসে এক জন বললেন, বর্তমানে এই রাজ্যে এবং কেন্দ্রে সরকারি চাকরির যে অবস্থা তাতে এই তরুনীর সাহসী পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানাই৷ আবার কেউ বলছেন, আমরা হলাম চা পিপাসু বাঙালি৷ ভীষণ ভালোবাসি চা খেতে৷ তবে আজ প্রথম এমএ পাস করা কোনও তরুনীর চায়ের দোকানে চা খেলাম। প্লাটফর্মের উপরে থাকা পার্শ্ববর্তী দোকানদারেরা বলছেন, আমাদের দোকানের পাশে এমন একজন শিক্ষিত মেয়ে চায়ের দোকান দেওয়াতে আমরা খুশি এবং গর্বিত৷ এবার থেকে টুকটুকির দোকান থেকেই চা খাবেন বলে জানিয়েছেন তাঁরা৷