১৯৮৩ থেকে ২০২০! পড়ুন, ভারতের ফাঁসি ইতিহাস, রয়েছে গণফাঁসির তথ্য

১৯৮৩ থেকে ২০২০! পড়ুন, ভারতের ফাঁসি ইতিহাস, রয়েছে গণফাঁসির তথ্য

নয়াদিল্লি: জঘন্যতম অপরাধে ভারতে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড৷ মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত কিনা, তা নিয়ে বিশ্ব দরবারে বহুবার প্রশ্ন উঠেছে৷ পক্ষে-বিপক্ষে সওয়াল জবাবও হয়েছে বিস্তর৷  কিন্তু এই প্রশ্নের সদুত্তর এখনও মেলেনি৷ স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত দেশে বহু ফাঁসি হয়েছে৷ যার সাম্প্রতিক সংযোজন নির্ভয়াকাণ্ডের চার অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড৷ শুক্রবার ভোরে তিহার জেলে ফাঁসি দেওয়া হয় মুকেশ সিং, অক্ষয় সিং ঠাকুর, বিনয় শর্মা এবং পবন কুমার গুপ্তকে৷ স্বাধীনতার পর এই নিয়ে দ্বিতীয়বার একসঙ্গে ফাঁসি দেওয়া হল চার অপরাধীকে৷

১৯৮৩ সালের ২৫ অক্টোবর পুণের ইয়েড়ওয়াড়া জেলে একসঙ্গে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল রাজেন্দ্র জাক্কাল, দিলীপ সুতার, শান্তারাম জগতাপ এবং মুনাওয়া এসকে৷ ১৯৭০ সালে জোশি-অভয়ঙ্কর হত্যা মামলায় ১০ জনকে খুনের অপরাধে চরম শাস্তি দেওয়া হয়েছিল তাদের৷ ২০০০ সালের পর থেকে এবং নির্ভয়া মামলার আগে পর্যন্ত ভারতে ফাঁসি হয়েছে চার অপরাধীর৷ তাদের মধ্যে প্রথম হল ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়৷

ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় (২০০৪)- ১৮ বছরের স্কুল ছাত্রী হেতাল পারেখকে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে ২০০৪ সালে ফাঁসি দেওয়া হয় ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়কে৷ যে অ্যাপার্টমেন্টে হেতালের পরিবার থাকত, ওই অ্যাপার্টমেন্টে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করত ধনঞ্জয়৷ ১৯৯০সালের ৫ মার্চ বিকেলবেলা ঘরের মধ্যে মৃত অবস্থায় হেতালকে পড়ে থাকতে দেখেন তাঁর মা৷ ওই ঘটনার পর থেকেই নিখোঁজ হয়ে যায় ধনঞ্জয়৷ শুরু হয় তদন্ত৷ ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ আনা হয় ধনঞ্জয়ের বিরুদ্ধে৷ ওই বছর ১২ মার্চ ধর্ষণ, খুন ও চুরির অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করে কলকাতা পুলিশ৷ ১৯৯১ সালে ধনঞ্জয়কে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে আলিপুর দায়রা আদালত৷

এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রথমে হাইকোর্ট ও পরে সুপ্রিম কোর্টে যায় সে৷ কিন্তু তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে উভয় আদালতই৷ এরপর তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন জানায় ধনঞ্জয়৷ কিন্তু তার আবেদন খারিজ করে দেন রাষ্ট্রপতি৷ ২০০৪ সালের ১৪ অগাস্ট আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ফাঁসি দওয়া হয় ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়কে৷

মহম্মদ আজমল আমির কাসভ (২০১২)-  ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর৷ মুম্বইয়ের তাজমহল প্যালেস, কামা হসপাতাল, নরিম্যান হাউস, ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস, ওবেরয় ট্রাইডেন্ট সহ একাধিক জায়গায় নাশকতা চালায় ১০ পাকিস্তানি জঙ্গি৷ মৃত্যু হয় ১৬৬ জনের৷ বাকি জঙ্গিরা পুলিশের গুলিতে খতম হলেও, একমাত্র জীবিত অবস্থায় ধরা পড়ে আজমল আমির কাসভ৷

২০০৯ সালে শুরু হয় ২৬/১১ মামলার শুনানি৷ ২০১০ সালে কাসভকে ফাঁসির সাজা শোনায় বিশেষ আদালত৷ কিন্তু কাসভের আইনজীবী বলেন, জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈবা তাঁর মক্কেলকে ভুল পথে চালিত করেছে৷ তাকে পুনর্বাসনের সুযোগ দেওয়া হোক৷ কিন্তু তার আবেদন নাকোচ করে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে বিচারক এমএল তাহালিয়ানি৷ তিনি জানান, ‘মানবিক আচরণ’ করার জায়গা হারিয়েছে কাসভ৷ এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মুম্বই হাইকোর্টে যান কাসভের কৌশলি৷

২০১০ সালে শুরু হয় মামলার শুনানি৷ নিরাপত্তার স্বার্থে ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে আদালতে হাজিরা দেয় কাসভ৷ ২০১১ সালে কাসভের আর্জি খারিজ করে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে মুম্বই হাইকোর্ট৷ ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের দরজায় কড়া নাড়ে এই পাক জঙ্গি৷ হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে ২০১২ সালে কাসভকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে শীর্ষ আদালত৷ তার প্রাণভিক্ষার আবেদনও খারজি করে দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়৷  ২০১২ সালের ২১ নভেম্বর মুম্বইয়ের ইয়েরওয়াড়া জেলে ফাঁসি হয় আজমলস কাসভের৷

মহম্মদ আফজল গুরু ও অন্যান্য (২০১৩)- ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ভারতীয় সংসদে হামলা চালায় লস্কর-ই-তৈবা ও জয়স-ই-মহম্মদের পাঁচ সশস্ত্র জঙ্গি৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ও সংসদের স্টিকার লাগানো গাড়ি নিয়ে সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ে তারা৷ গাড়ি থেকে নেমেই এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে জঙ্গিরা৷ পাল্টা গুলি চালায় নিরাপত্তাবাহিনী৷ পুলিশের গুলিতে মৃত্যু পাঁচ জঙ্গিরই৷ অন্যদিকে, জঙ্গিদের ছোড়া গুলিতে প্রাণ হারান আট নিরাপত্তারক্ষী ও সংসদে কর্মরত এক মালী৷ গুরুতর জখম হন আরও ১৩ জন৷

এই ঘটনায় ২০০১ সালের ১৫ ডিসেম্বর শ্রীনগর থেকে আফজল গুরু, তার ভাইপো সৌকত হুসেন গুরু, সৌকতের স্ত্রী আফসান গুরু এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবিকের প্রফেসার এসএআর গিলানিকে গ্রেফতার করে দিল্লি পুলিশ৷ অভিযোগ, সংসদে হালমার পিছনে ছিল তাদেরই মস্তিষ্ক৷ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধ খুন, খুনের চেষ্টা, ষড়যন্ত্র এবং ভারতের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার অভিযোগ আনা হয়৷ ২০০২ সালে যোগ করা হয় প্রিভেনশন অফ টেররিজম অ্যাক্ট (পোটা)৷

২০০১ সালে আফজল গুরু, সৌকত হুসেন এবং এসএআর গিলানিকে মৃত্যুদণ্ড দেয় বিশেষ আদালত৷ এই পরিকল্পনার গোপন করার অভিযোগে আফসান গুরুকে পাঁচ বছরের সাজা শোনায় আদালত৷ মামলা হাইকোর্ট অবধি গড়ায়৷ ২০০৩ সালে নিম্ন আদালতের রায় বহাল রেখে তিনজনকে ফাঁসির আদেশ দেন বিচারপতি৷ ২০০৫ সালের ২৪ অগাস্ট, আফজল গুরুর মৃত্যুদণ্ডের সাজা বহাল রাখে সুপ্রিম কোর্ট৷ তবে সৌকতের সাজা কমিয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়৷ আফজল গুরু সাজা পুনর্বিবেচনার আর্জি জানালেও কোনও লাভ হয়নি৷ ২০০৬ সালে গুরুর প্রাণভিক্ষার আবেদন খারিজ করে দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম৷ ২০১৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি দিল্লির তিহার জেলে সকাল ৮টায় ফাঁসি হয় সংসদে জঙ্গি হামলার ষড়যন্ত্রকারী আফজল গুরুর৷

ইয়াকুব মেমন (২০১৫)- ১৯৯৩ সালে মুম্বইয়ে ধারাবাহিক বিস্ফোরণে অভিযুক্ত ইয়াকুব মেমন ছিল এই ঘটনার অন্যতম মাস্টার মাইন্ড টাইগার মেমনের ভাই৷ এই ঘটনায় ছিল কুখ্যাত ডন দাউদ ইব্রাহিমের মাথাও৷ মুম্বই ধারাবাহিক বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল ২৫৭ জনের৷ পুলিশের দাবি, ১৯৯৪ সালের ৫ অগাস্ট নয়াদিল্লি স্টেশন থেকে গ্রেফতার করা হয় মেমনকে৷ অন্যদিকে মেমন জানিয়েছিল, ১৯৯৪ সালের ২৮ জুলাই কাঠমাণ্ডু পুলিশের কাছে আত্মসমর্পন করেছিল সে৷

২০০৭ সালের ২৭ জুলাই টাডা আইনে বিচার শুরু হয়৷ খুন, ষড়যন্ত্র, সন্ত্রাসবাদে মদত ও সন্ত্রাসমূলক কাজের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয় মেমনকে৷ তার বিরুদ্ধে আনা বেআইনি অস্ত্রপাচারের অভিযোগেও প্রমাণ হয়ে যায় আদালতে৷ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয় মেমন৷ এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শীর্ষ আদালতে যায় সে৷ সুপ্রিম কোর্ট নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখে৷ ২০১৫ সালের ২২ জুলাই তার কিউরেটিভ পিটিশনও খারিজ হয়ে যায় ৷ এরপর মহারাষ্ট্রের রাজ্যপালের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা আর্জি জানায় মেমন৷ কিন্তু তার আবেদন খারিজ করে দেন রাজ্যপাল৷ ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই নাগপুর জেলে ফাঁসি হয় মেমনের৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

19 − 17 =