কলকাতা: ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে এই প্রথম বাম শূন্য বাংলার বিধানসভা৷ ২০১১-র পর টিমটিম করে যে আলো জ্বলছিল, সবুজ ঝড়ে তা অস্তমিত৷ চূড়ান্ত ব্যর্থতা৷
আরও পড়ুন- চার্টার্ড বিমানে দিল্লি গিয়েও লাভ হল না যাদের…
বাংলা বিধানসভা ভোটে বামেদের এই বিপর্যয়ে দলীয় নেতৃত্বের চূড়ান্ত ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন রাজনীতির কারবারিরা৷ আরও একটি বিষয় হতে পারে, হয়তো আইএসএফ বা কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের জোট ভালো চোখে দেখেনি বাংলার মানুষ৷ এ প্রসঙ্গে চুলচেরা বিশ্লেষণের আগে মেনে নিতে হবে নিরাভরণ হওয়া বাস্তব সত্যটাকে৷ যেখানে দেখা যাচ্ছে ১৯৪৬ সালের পর এই প্রথম বাম-কংগ্রেস শূন্য বিধানসভা গঠিত হতে চলেছে বাংলায়৷
২০১৯ সালেও সে ভাবে দাঁত ফোটাতে পারেনি বামেরা৷ কিন্তু বিধানসভায় একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি৷ একুশের ঝড়ে টালমাটাল পায়ে এগিয়ে চলা বাম শিবির ধুয়ে মুছে সাফ৷ বিধানসভায় বামেদের ঝুলিতে কমে গিয়েছে আরও ২ শতাংশ ভোট৷ তাই যাঁরা উপর তলায় বসে নির্দেশ দেন, এই বিপর্যয়ের দায় ভার তাঁদের উপরেই বর্তায়৷ এত বড় ব্যর্থতার দায় উপেক্ষা করে শুধুমাত্র বিপর্য়ের কারণ বিশ্লেষণে বসে দায়িত্ব এড়াতে পারেন না শীর্ষ নেতৃত্বরা৷
বাংলার মসনদ দখলে এবার রাজ্যে ম্যারাথন সভা করেছেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা৷ কিন্তু মোদী ম্যাজিক এবার বাঙালি আবেগের কাছে ফিকে পড়ে গিয়েছে৷ মোদীর বিজয় রথ রুখে দিয়েছে বাংলার মানুষ৷ এনআরসি জুজুতে ভীত সংখ্যালঘু মানুষ তাঁদের ত্রাতা হিসাবে বেছে নিয়েছে তৃণমূলকে৷ কিন্তু কেন মানুষের মনে নিজেদের প্রতি আস্থা-ভরসা জাগাতে পারল না ৩৪ বছর বাংলায় রাজত্ব করা বামপন্থীরা? দলের কাণ্ডারী হয়ে নৌকার হাল ধরা সেই কুশীলবদের ব্যর্থতাই ধরা দিয়েছে একুশের ভোটের ফলাফলের পরতে পরতে৷
মানুষ সুচিন্তিত ভাবেই এবার ভোট দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসকে৷ কারণ বিজেপি’র বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য মানুষ আস্থা রেখেছে মা-মাটি মানুষের সরকারের উপর৷ যে আস্থা অর্জনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ বাম নেতৃত্ব৷ তন্ময় ভট্টাচার্যের কথায়, একদল বামপন্থী নেতার চিন্তা ভাবনা তাঁদের ফেসবুকে পোস্টে ফুটে ওঠে৷ সংসদীয় গণতন্ত্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরেও তাঁরা অংহকার করে বক্তৃতা করেন, ‘‘আমরা ভোটের রাজনীতি করি না, আমরা রাস্তায় থাকাই৷’’ তন্ময়বাবু বলেন, ‘‘তাঁদের মনস্কামনাই পূর্ণ হয়েছে৷ তাঁরা রাস্তাতেই থাকুন৷ যাঁরা ভোটের রাজনীতি করে তাঁরা ভোট পেয়েছে৷ আপনারা যাতে রাস্তায় নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন, তার জন্য মানুষ আপনাদের হাতে একটা ফুটো বাটি ধরিয়ে দিয়ছে৷ এবার আপনারা ভাবুন বাটি হাতে নিয়ে ঘুরবেন, না ভোটের রাজনীতি করবেন?’’
এখানেই থেকে থাকেননি তন্ময় ভট্টাচার্য৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার কথা শুনে আমার দলের শৃঙ্খলাবদ্ধ সৈনিকরা বলছেন, এই সব কথা দলের অন্দরে আলোচনা করতে হয়, প্রকাশ্যে নয়৷ কিন্তু যেখানে গোটা সিস্টেমটাই উলঙ্গ হয়ে গিয়েছে, সেখানে কীসের ভিতর, আর কীসের বাইরে?’’ তাঁর কথায়, কোনও ভাবেই নেতারা যেন অজুহাত সৃষ্টি না করেন৷ নীতিগত ভাবে রাজ্যের মানুষ বিপুল ভাবে বামপন্থীদের প্রত্যাখ্যান করেছেন৷ কোনও বাম প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আলোচনা করাটা যুক্তিহীন হবে৷
বামপন্থীদের কাছ থেকে বিরোধী দলের মর্যাদাটুকুও কেড়ে নিয়েছে মানুষ৷ তাঁদের ন্যূনতম যোগ্য বলেও মনে করেনি৷ ফেব্রুয়ারি মাসে যাঁরা ব্রিগেডে এসেছিলেন, সেই সকল মানুষ ও তাঁদের পরিবার বাম জোটকে ভোট দিয়েছে কিনা, তা নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে৷ তন্ময়বাবুর কথায়, বাম নেতৃত্বের মধ্যে মানুষকে বোঝার ক্ষমতা রয়েছে কিনা, সেটাও ভেবে দেখার সময় এসে গিয়েছে৷
আরও পড়ুন-একুশ ছিল চ্যালেঞ্জ, বাংলা দেশে BJP’র ধস নামিয়েছে, এটাই টার্নিং পয়েন্ট, বললেন মমতা
তন্ময়বাবুর ইঙ্গিত যে বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র এবং মহম্মদ সেলিমের মতো নেতাদের দিকে তা স্পষ্ট৷ ভোটের ফল প্রকাশের পর বিমানবাবু বিবৃতি দিয়ে দায় সেরেছেন৷ বলেছেন, এই পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করা হবে৷ সেই পর্যালোচনা থেকে শিক্ষা নেব৷ কিন্তু তিনি কোনও ভাবেই পরাজের দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নেননি৷ ‘উলঙ্গ’ হয়ে যাওয়া সিস্টেমের কথা স্বীকার করেননি৷ বিমানবাবুর জীবন যে কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কাছেই নিশ্চিত ভাবে রোল মডেল৷ যিনি নিজের সারা জীবন দলের জন্যই উৎসর্গ করেছেন৷ কিন্তু কোনও দল যখন পরাজিত হয়, তাঁর দায় ক্যাপ্টেনের উপরেই বর্তায়৷ সেই দায় থেকে মুখ ফেরাতে পারেন না তিনি৷ একুশের ভোটে এই ভরাডুবির পর যোগ্য নেতার মতোই সরে দাঁড়ানোই উচিত ছিল তাঁর৷ উচিত ছিল আগামী প্রজন্মের জন্য পথ প্রস্তুত করে তাঁদের হাতে ব্যাটন তুলে রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়া৷ না, তিনি তা করেননি৷ তিনি যদি সরে দাঁড়ান, তাহলে নতুন করে প্রকাশিত হবে এই প্রতিবেদন৷
বাম-শূন্য বিধানসভা, এর দায় নিতে আপত্তি কোথায় ? এই ফলাফল দেখেও কি পদ আকড়ে থাকার প্রয়োজন অনুভব করছেন বিমান-সূর্যবাবুরা? লড়াই যখন শূন্য থেকে শুরু করার, তখন কেন নতুন হাতে যাচ্ছে না ‘উলঙ্গ’ ব্যবস্থাপনা? অন্তত শূন্যের নিচে তো আর কোনও ফলাফল হবে না৷ যা ঘটনার ঘটে গিয়েছে৷ এবার পদত্যাগের খবরটা আসা খুবই জরুরি!