তপন মল্লিক চৌধুরী : করোনার মধ্যে বিহার বিধানসভা নির্বাচন মিটেছে শান্তিতে। আগামীকাল ফলাফল ঘোষণার পরও কোথাও কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না বলেই মনে হচ্ছে। এবার এনডিএ-এর পাল্লা ভারী বলেছিল ওপিনিয়ন পোল। সমীক্ষা বিজেপিকে এগিয়েই রেখেছিল। কিন্তু এক্সিট পোলে পিছিয়ে পড়ল এনডিএ।আরএগিয়ে এল মহাগঠবন্ধন। অন্যদিকে চিরাগ পাসওয়ানের এলজেপির ভূমিকা যে ভোট কাটা ছাড়া আর কিছুই নয় সেটাও উঠে এল।
বেশিরভাগ সমীক্ষা জানিয়েছে, ম্যাজিক ফিগার ছোঁয়ার দৌড়ে এখনও পর্যন্ত সামনে রয়েছে মহাগঠবন্ধন। তার মানে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল তেজস্বী যাদবের। কিন্তু এর আগে অধিকাংশ সমীক্ষা বলেছিল, ফের বিহারের কুর্শিতে বসবেন নীতিশ কুমার। বিহার বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে চিরাগ পাসওয়ানের দল বড় ভূমিকা নিতে না পারলেও তারা ভোট কেটে এনডি-এর যাত্রাভঙ্গ করবে। কিন্তু এক্সিট পোলের হিসাব যদি এদিক ওদিক হয়ে যায় তাহলে তাহলে ওপিনিয়ন পোলের হিসাব অনুযায়ী এনডিএ ফের ক্ষমতায় ও নীতিশই বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্শতে বসছেন।
যদিও বেশিরভাগ বুথ ফেরত সমীক্ষা অনুযায়ী কংগ্রেস-আরজেডিও ও বাম দল নিয়ে গঠিত মহাগঠবন্ধনের পাল্লা ভারী। সেটাই যদি ঘটে যায় তাহলে বিহারের ইতিহাসে একথা অবশ্যই লেখা হবে যে ২০২০ সালের ১০ নভেম্বর ভারতীয় রাজনীতি্র আকাশে নতুন একটি তারার উদয় হল, তাঁর নামতেজস্বী যাদব। এর সঙ্গে একথাও লেখা হবেযে তাঁর একার যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন নরেন্দ্র মোদী-সহ নীতিশ কুমার। যদিও দেশের প্রেক্ষিতে প্রথমজন জনপ্রিয়তার শিখর থেকে কিছুটা হলেও তলায় নেমেছেন আর দ্বিতীয়জন তাঁর নিজের রাজ্যে ইতিমধ্যে অনেকটাই পিছনে পড়েছেন।
উল্লেখ্য সাড়ে পাঁচ দশক আগে এই বিহার ভারতীয় রাজনীতিকে পথ দেখিয়েছিল। জরুরি অবস্থার সময় জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল এই বিহার থেকে।জরুরি অবস্থার সময় লালুপ্রসাদ যাদব,নীতীশ কুমার আররামবিলাস পাসওয়ানকে একমঞ্চে হাজির করেছিলেন জেপি। পরবর্তীতেযে যার নিজের রাজনৈতিক পথ খুঁজে নিয়েছিলে। তবে ২০০৫-এর আগে পর্যন্ত বিহারের রাজনীতিকে তালুবন্দি করে রেখেছিলেন এই তিনমূর্তি। তবে বিহারের মসনদে লালুপ্রসাদ ও নীতীশকুমার বসতে পারলেও রামবিলাসের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় নি।যদিও বিহার বিধানসভার সদস্য থেকে তিনি কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে পৌঁছে মন্ত্রীত্ব লাভ করেছিলেন।
বিহার জাতপাতের রাজনীতিতে দেশের অন্যতম রাজ্য। দেশের তৃতীয় বৃহৎ এবং দেশের সবথেকে দরিদ্র রাজ্য, অপরাধ আর দুর্নীতিতেও সবথেকে এগিয়ে। লালুপ্রসাদ আর তাঁর স্ত্রী রাবরি দেবী মিলে বিহার শাসন করেছেন প্রায় ১৫ বছর।২০০৫ সালে ক্ষমতায় আসেন নীতীশ কুমার৷ তিনিও এ বছরই তাঁর শাসনকালের ১৫ বছর পূর্ণ করতে চলেছেন। দুই পর্বেই চলেছে রাজনীতির বহু অঙ্ক। লালুপ জমানায়শিল্প বলতে যেটুকু ছিল এখন তার অর্ধেক। কাজের জন্য অধিকাংশ মানুষকে অভিন রাজ্যে যেতে হয়। রাজ্যে সরকারিভাবে মদ নিষিদ্ধ কিন্তু তা শুধুমাত্র খাতায় কলমে। রাজ্যের সর্বত্র বেশি দামে মদ পাওয়া যায়। রাস্তা-বিদ্যুত-জল এইশ্লোগান তুলে কুর্শিতে বসেছিলেন নীতীশ। এখন সে রাজ্যের অধিকাংশ রাস্তাই ভাঙাচোরা, পানীয় জলের সংকট লেগেই আছে।
বিগত কয়েক বছর ধরে বিহার অর্থনৈতিক অবস্থা চরম খারাপ। বেকারত্ব সব রেকর্ড ছাপিয়ে গিয়েছে। ২৩.৯% হ্রাস জিডিপিতে। চূড়ান্ত দুর্নীতিগ্রস্ত বিহারে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে নারী সুরক্ষা বলতে কিছুইপ্রায় নেই। এরকম একটা কঠিন পরিস্থিতিতে বিহারে ভোট হল নির্বিঘ্নে। তবে এবারের নির্বাচনে বারবার সামনে এসেছে বিহারের কর্মসংস্থান। যে রাজ্য্যে সরকারি সমীক্ষা অনুযায়ী ৪৬.৬% বেকার। লক ডাউনের সময় বাইরের রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের অধিকাংশই ছিল বিহারের মানুষ। ভিন রাজ্য থেকে প্রায় ২৩ লক্ষমানুষ কয়েকশো মেইল হেঁটেঘরে ফিরেছেন। অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন।
বিহার বিধানসভা নির্বাচনী প্রচারে তেজস্বী যাদব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ক্ষমতা এলে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই ১০ লাখ চাকরির ব্যবস্থা করবেন। নীতীশ কুমার বলছেন, এতো পয়সা নেই। তবে তাঁর শরিক বিজেপি বলেছে, ১৯ লাখ চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিহার ভোটে এই প্রথম জাতপাতের রাজনীতির বদলে সামনে এসেছে কর্মসংস্থান। এসেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। এবারবিহার বিধানসভা ভোটেলক্ষ্যনীয় বিষয়; বহুদিন পর ভোটে মানুষের বেঁচে থাকার খুটিনাটি সমস্যাগুলি সামনে এসেছে। মানুষ প্রচার সভায় নেতাদের সামনে চাকরি, জিনিসপত্রের দাম ইত্যদির আওয়াজ তুলেছেন। বিজেপি সাম্প্রদায়িক হিন্দু-মুসলমান তাস খেলার চেষ্টা করলেও কাজহারা, ভুখা বিহারবাসী আর মনে হয় হিন্দুত্বের গর্বে গরীয়ান হতে চান না।